এজন্য পর্যাপ্ত আমদানি, মজুদ ও সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সরকার। রমজানে পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে ও ন্যায্য দামে ভোক্তাদের হাতে পৌঁছে দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় পর্যায়ে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বিভাগীয় কমিশনারদের চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন। ওই চিঠিতে বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বছরের অন্য সময়ের মতো রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ভোক্তাদের কাছে ন্যায্যমূল্যে মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। স্থানীয় পর্যায়ে পণ্যের মূল্য সহনীয় রাখার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য যাতে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, সে বিষয়টি নিশ্চিতের লক্ষ্যে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রমজানে ভেজালবিরোধী অভিযান জোরদার করা প্রয়োজন। দেশের সব জেলা ও উপজেলায় বাজারে পণ্য সরবরাহ ও মজুদ অটুট রাখা, নির্বিঘ্নে পণ্য পরিবহন, অবৈধ মজুদ প্রতিরোধ এবং পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ভ্রাম্যমাণ আদালত কার্যক্রম জোরদারসহ প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আপনার আন্তরিক উদ্যোগ ও সহযোগিতা কামনা করছি’।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রমজানের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি পণ্য দেশে মজুদ রয়েছে। তাই কৃত্রিমভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণের কারসাজি হলে জড়িতদের কোনোরকম ছাড় দেওয়া হবে না। এ ব্যাপারে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও নজরদারি করা হচ্ছে। রমজানে চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে পণ্যের আমদানি ও মজুদের মধ্যে সমন্বয় রাখতে ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক থাকলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সরকারের কাছে এখন পর্যন্ত যে তথ্য রয়েছে, তাতে রমজানের চাহিদার তুলনায় বেশি পণ্যসামগ্রী আমদানি হওয়ায় মজুদ পরিস্থিতি সন্তোষজনক। তবে রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে সেগুলোর মজুদ আরও বাড়ানো হচ্ছে। ওই সময়ের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে আমদানি বাড়ানোসহ যা করণীয় সরকারের পক্ষ থেকে সব করা হবে। এছাড়া এবার সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা টিসিবির কার্যক্রম আরও বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
খাদ্যসচিব শাহাবউদ্দিন আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, রমজান উপলক্ষে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়েছে। যেমন- ওএসএস এর মাধ্যমে নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দেওয়ার জন্য রমজান মাসে ১৮ টাকা কেজি দরে আটা এবং ৩০ টাকা দরে চাল বিক্রি অব্যাহত থাকবে। দেশের ৩৩৬টি জেলা শহরে ৬৩৯টি বিক্রয় কেন্দ্রে আটা ও চাল বিক্রয় করা হবে।
এদিকে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে এ সংক্রান্ত একটি জরুরি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে জরুরি ভিত্তিতে পনেরটি উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এগুলো হলো- পর্যাপ্ত আমদানি ও মজুদের বিষয়টি নিশ্চিত করা, ম্যানুপুলেটের সুযোগ বন্ধ করে বাজারে চাহিদামতো পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা, বাজারগুলোতে গোয়েন্দা সংস্থা, র্যাব ও পুলিশের তদারকি কার্যক্রম বাড়ানো, ফেরি পারাপারে পণ্যবাহী ট্রাক অগ্রাধিকার দেওয়া, মহাসড়কে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে পণ্যবাহী ট্রাক নিরাপদে বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর ও অধিদফতরের নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা, ট্রাকসেলে টিসিবির বিক্রি কার্যক্রম অব্যাহত রাখা ও পণ্যের পরিমাণ বাড়ানো, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের কার্যক্রম বাড়ানো, ভেজালরোধে নিরাপদ খাদ্য অধিদফতরের উদ্যোগ নেওয়া, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন ভর্তুকি মূল্যে বাজারে চিনি বিক্রি করবে, পণ্যসরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে রাস্তায় ট্রাফিক জট কমানো, ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা, এক মাস রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ, স্থল বন্দরগুলোতে পেঁয়াজ, রসুনসহ মসলা জাতীয় পণ্যের দ্রুত ছাড় করা, বাজারে সবজির সরবরাহ বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকা টানানো প্রভৃতি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রায় ২২ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে এক লাখ ৭০ হাজার টন চাহিদা থাকলেও শুধু রোজার মাসে চাহিদা দাঁড়ায় ৫ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে ২৩ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। আসন্ন রমজান উপলক্ষে ৮ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের এলসি খোলা হয়েছে।
এছাড়া রমজানে প্রায় ৮০ হাজার টন ছোলার চাহিদা থাকলেও মার্চ মাস পর্যন্ত আমদানি করা হয় ৮৯ হাজার ৩৯০ টন এবং এলসি খোলা হয়েছে ৮৪ হাজার ৭৪৮ টনের। ফলে তথ্য অনুযায়ী চাহিদার চেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে।
দেশে পর্যাপ্ত মসুর ডাল আমদানি করা হয়েছে রমজান উপলক্ষে। এর মধ্যে রমজানের চাহিদা হচ্ছে ৮০ হাজার মেট্রিক টন। এ সময় আমদানি করা হয় ১ লাখ ৮৭ হাজার টন এবং এলসি খোলা হয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন ডালের।
রোজার চাহিদাকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা চিনিও পর্যাপ্ত আমদানি করেছেন। রোজায় চিনির চাহিদা হচ্ছে ৩ লাখ মেট্রিক টন। এ পর্যন্ত আমদানি করা হয়েছে ১০ লাখ ৭০ হাজার টন। পাশাপাশি এলসি খোলা হয়েছে ১৪ লাখ ৪৭ হাজার টন। রোজার চাহিদার কয়েকগুণ বেশি চিনি আমদানি হয়েছে।
দেশে খেজুরের বার্ষিক প্রায় ২০ হাজার টন চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা প্রায় ১৮ হাজার টন। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম আট মাসে প্রায় ৪০ হাজার টন খেজুর দেশে আমদানি হয়েছে।
রমজানে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য হচ্ছে ভোজ্যতেল। দেশে ১৫ লাখ টন ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা রয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে এক লাখ ১০ হাজার টন সয়াবিন ও পাম অয়েলের চাহিদা রয়েছে। শুধু রমজান মাসে চাহিদা প্রায় আড়াই লাখ টন। এর মধ্যে আট লাখ ৬৪ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৭ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০১৯
জিসিজি/জেডএস