জাতীয় মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসটিআই বলছে, নিম্নমানের এসব পণ্য বাজারে পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। অন্যদিকে, বেশিরভাগ কোম্পানিই নিজেদের নিষিদ্ধ হওয়া পণ্য বাজার থেকে তুলে নিলেও এগুলো নতুন নামে বাজারে আসার আশঙ্কা করছেন ভোক্তারা।
গত ১২ মে নিম্নমানের এসব পণ্য বাজার থেকে জব্দ করে ধ্বংস করতে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর ও ভোক্তা অধিদপ্তরকে নিদের্শ দেন হাইকোর্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএসটিআই ১৮ মে’র মধ্যে পণ্যগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়ার নিদের্শ দিলেও সপ্তাহ পরেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য।
শনিবারর (২৫ মে) রাজধানীর ধূপখোলা মাঠ, দয়াগঞ্জবাজার, সূত্রাপুর, নয়াবাজার, রায়সাহেব বাজার, ঠাঁটারিবাজার, কাপ্তানবাজার, সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন বাজারের ডিপার্টমেন্ট স্টোরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এসব বাজারের বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে তীর ও প্রাণের পণ্য সরানো হলেও মোল্লা সল্ট, ডুডলি কোম্পানির মালামাল সরানো হয়নি। পাশাপাশি বাজারের ছোট ছোট স্টোরগুলো থেকে কোনো পণ্যই সরানো হয়নি। আর বিক্রেতারা এসব পণ্য দোকানের সামনে না রেখে গুদামে রেখে বিক্রি করছেন। ক্রেতারা এমন ধরনের পণ্য চাইলে তাদের না দেখিয়েই ব্যাগে ঢুকিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এসিআই, মোল্লা সল্টের পণ্য এখনো বাজারে রয়ে গেছে। পণ্য উঠিয়ে নিতে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি প্রতিষ্ঠানটি দু’টিকে। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো খবর নেই বললেই চলে। অনেক ব্যবসায়ী এ বিষয়ে কিছু জানেনও না। আবার অনেকে জেনেও বিক্রি করছেন। এতে ভোক্তারা প্রতারিত ও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
জানা গেছে, বিভিন্ন কোম্পানির নিম্নমানের ৫২টি পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে বিএসটিআই। একইসঙ্গে অভিযান পরিচালনা করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও। গত ১৯ মে সকাল থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, পুরান ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বাজার ও দোকানে অভিযান চালানো হয়। প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) এস এম ইয়াসাক আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বিভিন্ন জায়গায় নিষিদ্ধ হওয়া পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি। বেশিরভাগ পণ্যই বাজার থেকে কোম্পানি নিজেই উঠিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এখনো এসিআই, মোল্লা সল্ট, ডুডলির কয়েকটি পণ্য আমাদের অভিযানে পাওয়া গেছে। সারাদেশের অভিযান শেষে একসঙ্গে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, শুধু ৫২টি পণ্য নয়, বাজারে মানহীন খোলা হলুদ, মরিচসহ বিভিন্ন গুঁড়া মসলাও জব্দ করেছে বিএসটিআই। সংস্থার অনুমোদনহীন কোনো পণ্য বাজারে আছে কি-না তা দেখতেও এই অভিযান চলবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করে এসব পণ্য বিক্রি না করতে বলেছি। এরপরও ব্যবসায়ীদের এসব পণ্য বিক্রির পেছনে কোনো অজুহাত থাকতে পারে না। প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব পণ্য বাজার থেকে ফেরত নিচ্ছে সেগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের সামনে নষ্ট করতে হবে। যেসব পণ্য বাজার থেকে সরিয়ে নিচ্ছে সেগুলো যেন বাজারে আসতে না পারে সেদিকে আমরা নজর রাখছি। আমাদের উপস্থিতিতেই সেসব পণ্য নষ্ট করতে হবে।
বিএসটিআই সূত্রে জানা গেছে, অভিযানে বেশিরভাগ দোকানেই নিষিদ্ধ ঘোষিত ৫২টি পণ্যের কোনোটিই পায়নি বাজার মনিটরিং টিম। তবে কারওয়ান বাজার ও নিউমার্কেটের কয়েকটি দোকানে নিষিদ্ধ তালিকায় থাকা কয়েকটি পণ্য বিক্রির জন্য মজুত অবস্থায় পায় টিম। এগুলোর মধ্যে মোল্লা সল্ট এবং ডুডল ব্র্যান্ডের নুডলস অন্যতম। এ সময় কারওয়ান বাজারের নাসির স্টোরকে ১০ হাজার টাকা এবং নিউমার্কেটে জব্বার স্টোর ও বিসমিল্লাহ স্টোরকে ২ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, বিক্রি-নিষিদ্ধ পণ্যের বেশিরভাগ পণ্য উৎপাদনক প্রতিষ্ঠান ফেরত নিয়ে গেছে। এছাড়া যেসব পণ্য এখনো বাজারে রয়ে গেছে সে বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তারা দু-একদিনের মধ্যে নিয়ে যাবে। তবে অনেক দোকানি এসব পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কিছুই জানেন না।
রায়সাহেব বাজারের হাজী নাসু স্টোরের মো. সোহরাব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, তীর ও প্রাণের পণ্য নিয়ে গেছে। এখনো এসিআই মোল্লা, ডুডলি, বাঘাবাড়ি কোম্পানির পণ্য বাজারে রয়ে গেছে। আমরা এসব পণ্য গুদামে রেখে দিয়েছি। তবে কেউ যদি চায় তাহলে দেওয়া হয়।
কাপ্তানবাজারের পাশে এক গলিতে কবির স্টোরে দেখা যায় ডুডলির নুডুলস বিক্রি হচ্ছে, জানতে চাইলে কবির হাওলাদার বলেন, ভাই আমরা গলির দোকানদার। বাজার থেকে মাল কিনে এখানে বিক্রি করি। কোম্পানি থেকে মাল নেই না। ফলে বাধ্য হয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে।
ঠাঁটারি বাজারের মহাদেব স্টোরের বাবুল রায় বাংলানিউজকে বলেন, আমার দোকানে নিষিদ্ধ নিম্নমানের পণ্যগুলোর মধ্যে কিছু পণ্য আছে। সেগুলো সামনে রেখে বিক্রি করা যায় না। ক্রেতারা চাইলে দেই। নামি দামি কোম্পানিগুলো পণ্য নিয়ে গেছে। তবে বেনামি কোম্পানির পণ্য এখনো বাজারে রয়ে গেছে। এগুলো নিয়ে আমরা পড়েছি সমস্যায়। ২০ টাকার পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে হাজার হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়। অথচ নিম্নমানের পণ্যের সব দায় কোম্পানির।
বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়া ৫২টি পণ্য হলো; তীর, জিবি, পুষ্টি ও রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের সরিষার তেল, সান ব্র্যান্ডের চিপস, আরা, আল সাফি, মিজান, দিঘী, আর আর ডিউ, মর্ন ডিউ ব্রান্ডের ড্রিংকিং ওয়াটার, ডানকানের ন্যাচারাল মিনারেল ওয়াটার, প্রাণ, মিষ্টিমেলা, মধুবন, মিঠাই, ওয়েল ফুডের লাচ্ছা সেমাই, ডুডলি ব্র্যান্ডের নুডলস, টেস্টি তানি তাসকিয়া ও প্রিয়া সফট ড্রিংক পাউডার, ড্যানিশ, প্রাণ, ফ্রেস ব্র্যান্ডের হলুদের গুঁড়া, এসিআই পিওর ব্র্যান্ডের ধনিয়া গুঁড়া, প্রাণ ও ড্যানিশ ব্র্যান্ডের কারি পাউডার, বনলতা ব্র্যান্ডের ঘি, পিওর হাটহাজারির মরিচের গুঁড়া, এসিআই, মোল্লা সল্টের আয়োডিনযুক্ত লবণ, কিং ব্র্যান্ডের ময়দা, রূপসা ব্র্যান্ডের দই, মক্কা ব্র্যান্ডের চানাচুর, মেহেদি ব্র্যান্ডের বিস্কুট, বাঘাবাড়ীর স্পেশালের ঘি, নিশিতা ফুডসের সুজি, মধুবনের লাচ্ছা সেমাই, মঞ্জিল ফুডের হুলুদের গুঁড়া, মধুমতি ব্র্যান্ডের আয়োডিনযুক্ত লবণ, সান ব্র্যান্ডের হলুদের গুঁড়া, গ্রীনলেনের মধু, কিরণ ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই, ডলফিন ব্র্যান্ডের মরিচের গুঁড়া, ডলফিন ব্র্যান্ডের হলুদের গুঁড়া, সূর্য ব্র্যান্ডের মরিচের গুঁড়া, জেদ্দা ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই, অমৃত ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই, দাদা সুপার, তিনতীর, মদিনা, স্টারশীপ ও তাজ ব্র্যান্ডের আয়োডিন যুক্ত লবণ।
রমজান মাস উপলক্ষে খোলা বাজার থেকে ৪০৬টি খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে বিএসটিআই। প্রতিবেদন পাওয়া ৩১৩টি পণ্যের মধ্যে এ ৫২ পণ্য নিম্নমানের প্রমাণিত হয়। ওই প্রতিবেদন যুক্ত করে রিট করে কনশাস কনজুমার সোসাইটি নামে একটি সংগঠন। পরে গত ১২ মে রোববার এই ৫২টি খাদ্যপণ্য বাজার থেকে তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৯
জিসিজি/এইচএ/