চার পেরিয়ে পাঁচ বছরে পা দিয়েছে ছাগলনাইয়া-শ্রীনগর সীমান্ত হাট। শুরুর দিকে দুই বাংলার মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে বেশ চাঙ্গা ছিল হাটের ব্যবসায়িক কার্যক্রম।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সে দেশের প্রশাসন মাত্র ৫শ’ লোক ছাড়া আর কাউকেই হাটে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না, যেটা শুরুর দিকে ছিল না। এ কারণে, বর্তমানে বাংলাদেশি দোকানগুলোতে বিক্রি কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে।
অপরদিকে, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাধারণ ক্রেতারা হাট থেকে পণ্য কিনে নিয়ে যাওয়ার সময় বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনী নানা অজুহাত দেখিয়ে তা রেখে দেয়, যদিও ২শ’ ডলার সমমূল্যের পণ্য কেনার বৈধতা আছে। কেনা পণ্য বিজিবি রেখে দেওয়ার কারণে ক্রেতারা হাটে আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
এ দুরাবস্থার জন্য দুই দেশের ব্যবসায়ীরা দায়ী করছেন হাট পরিচালনায় অব্যবস্থাপনাকে।
সম্প্রতি হাটে গিয়ে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া যায় বেশ কিছু তথ্য।
অসম বাণিজ্য:
বাংলাদেশ ও ভারত, দু’দেশের পারস্পরিক সমঝোতায় সীমান্ত এলাকার মানুষের কল্যাণের জন্য চালু হয়েছিল সীমান্ত হাটটি। কিন্তু বিগত চার বছরে হাটের কার্যক্রম ও আর্থিক লেনদেন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এতে রয়েছে অসম বাণিজ্য। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণে পণ্য বিক্রি করছেন, তার তুলনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বিক্রি খুবই নগণ্য।
ছাগলনাইয়া উপজেলার পূর্ব মধুগ্রাম ও ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার শ্রীনগরের মধ্যে সীমান্ত এলাকার এ হাট নিয়ে শুরুর সময় দুই দেশের পক্ষ থেকেই অনেক আশার কথা শোনানো হয়েছিল। সে সময় বলা হয়েছিল, আশপাশের পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় বসবাসরত দুই দেশের দেড় থেকে তিন হাজার মানুষ এ হাটে এসে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাবেচার সুযোগ পাবেন। প্রতি মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত হাট খোলা থাকবে। কয়েকটি আধাপাকা ঘর নিয়ে গড়ে তোলা এ হাট শুরুতে স্থানীয়দের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলে। বিজিবি বা বিএসএফ’কে পাস বা পরিচয়পত্র দেখিয়ে বাজারে প্রবেশের নিয়ম করা হয়। কোন দেশের বিক্রেতারা কী কী বিক্রি করতে পারবেন, তার একটি তালিকাও ঠিক করে দেওয়া হয়।
কিন্তু এখন বেশিরভাগ নিয়মই মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের।
হাটের বাংলাদেশি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি মো. আতাউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কড়াকড়িতে সে দেশের ক্রেতারা হাটে কম আসে। তবে চুক্তির বাইরে ভারতীয় পণ্য ঠিকই বাজারে আসছে। বাংলাদেশি একটি চক্র বিজিবি সদস্যদের হাত করে এসব ভারতীয় পণ্য বাজারে ঢোকার ব্যবস্থা করছে। ভারতের ক্রেতারা বাজারে না আসায় অসম বাণিজ্যের কারণে এ দেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, প্রতি হাটে বাংলাদেশের ২৭ দোকানি মিলে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করতে পারেন, বিপরীতে ভারতীয় ২৭ দোকানি মিলে বিক্রি করেন ৬ থেকে ৭ লাখ টাকারও বেশি পণ্য।
ফেনী কাস্টমস, শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগের তথ্য মতে, বিগত ছয় মাসের ২৫টি হাটে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেছেন প্রায় ৩ কোটি ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। অপরদিকে, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেছেন ২ কোটি ২৫ হাজার টাকার মতো।
সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ফজলুল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কদর ভারতীয় পণ্যের:
ফেনীর ছাগলনাইয়া ও ভারতের ত্রিপুরা শ্রীনগর সীমান্ত হাট ভারতীয় পণ্যের দখলে। দুই দেশের পণ্য বেচাকেনার হিসাবেও ঢের পিছিয়ে বাংলাদেশ। এ হাটে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা গাড়ি হাঁকিয়ে হাটে ঢুকে অবাধে ভারতীয় মালামাল কিনছেন। অপরদিকে, ভারতীয় অংশে কড়াকড়ি থাকায় বাংলাদেশি পণ্যের বেচাকেনা একেবারেই কম। দুই দেশের বৈধ পণ্যের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্যসহ উভয় দেশের জনগণের মধ্যে ভাব বিনিময় ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচনা ছিল এ হাটের উদ্দেশ্য। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো।
ছাগলনাইয়া সীমান্ত হাটে সরেজমিনে দেখা যায়, ভারতীয় পণ্যের আধিক্য। নির্দিষ্ট পণ্য তালিকার বাইরেও অনেক পণ্যসামগ্রী বেচাকেনা হচ্ছে।
ফেনী, ছাগলনাইয়া ও বারইয়ারহাটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এ বাজার থেকে পণ্য চোরাচালান করেন। দাম কম হওয়ায় বাংলাদেশিরা অনেকটা হুমড়ি খেয়ে ভারতীয় পণ্য কিনছেন।
বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা জানান, এ বাজারের শতকরা ৯০ শতাংশ ক্রেতাই বাংলাদেশি, তারা ভারতীয় পণ্য কিনছেন। আর ১০ শতাংশ ভারতীয়, যারা বাংলাদেশি পণ্য কিনছেন।
ক্রেতারা জানান, হাটে ভারতীয় অংশে কোনো ধরনের খুচরা পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। হরলিক্স, গুঁড়ো দুধ, প্যাম্পার্সসহ ভারতীয় সব প্রসাধনী কিনছেন তারা।
বাংলাদেশি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি আতাউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশি বাজারে মাছ, শুঁটকি, মুদি মালামাল, বেকারি ও প্লাস্টিক পণ্য বিক্রি হলেও ভারত থেকে তেমন কোনো ক্রেতা আসছেন না। হাটে প্রবেশে সে দেশের কড়াকড়ি থাকায় অলস সময় কাটাচ্ছেন বাংলাদেশি বিক্রেতারা।
সক্রিয় চোরাচালান চক্র:
সীমান্ত হাটকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একটি চোরাচালান চক্র। অভিযোগ রয়েছে, তারা বিজিবি ও প্রশাসনের লোকজনকে হাত করে হাট ব্যবহার করে চোরাচালান করছেন। অনেক ব্যবসায়ী সীমান্ত হাটে লোক ঢুকিয়ে ভারতীয় পণ্য কিনে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করছেন। এতে অসন্তোষ বিরাজ করছে স্থানীয় ছাগলনাইয়া ও ফেনী শহরের সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তারা বলছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সীমান্ত হাট থেকে নিম্নমানের ভারতীয় পণ্য কিনে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করছেন। এর ফলে, দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অপরদিকে, হাটের মাধ্যমে সাধারণ পণ্যের বাইরে বিভিন্ন মাদকদ্রব্যও তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করাচ্ছেন। সম্প্রতি, হাটের পাশের এলাকা থেকে বেশ কিছু যৌন উত্তেজক ওষুধ উদ্ধার করা হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চোরাচালানকারীরা সীমান্ত হাট ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে মাদক ও নানা পণ্যসামগ্রী চোরাচালান করছেন।
অবশ্য, হাটে নিয়ম ভেঙে পণ্য আসার সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের কোনো যোগাসাজশ থাকার কথা অস্বীকার করেছেন ফেনী ৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. নাহিদুজ্জামান।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বিজিবি সীমান্ত হাটের নিরাপত্তা ও সার্বিক দেখাশোনায় সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছে বিজিবি।
তৈরি হয়েছিল অচলাবস্থা:
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অসম বাণিজ্যের অভিযোগে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ধর্মঘটের কারণে টানা চারটি হাট বন্ধ থাকায় প্রায় এক মাস ধরে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। ধর্মঘটের কারণে দুই দেশের ক্রেতা-বিক্রেতারা বাজারে আসতে পারেননি। দূর-দূরান্ত থেকে হাটে এসে ফিরে গেছেন অসংখ্য ক্রেতা-দর্শনার্থীরা।
পরে, হাট পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ভারত ও বাংলাদেশি কর্মকর্তারা আলোচনায় বসে আবার হাট চালু করেন।
ফেনী সীমান্ত হাট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আতাউর বাংলানিউজকে বলেন, নিয়ম ছিল, একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুইশ’ ডলারের পণ্য কিনতে পারবেন। ভারতীয় ক্রেতারা পাঁচ কেজির বেশি পণ্য কিনলে বিএসএফ আটকে দেয়। আর বাংলাদেশি ক্রেতারা তিন থেকে চারশ’ ডলারের পণ্য কিনলেও বিজিবি বাধা দেয় না। এ পরিস্থিতিতে অব্যাহতভাবে লোকসান গুনতে হচ্ছে অভিযোগ তুলে বাংলাদেশি বিক্রেতারা গত ১৫ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডাকেন। এরপর, এক মাস ধরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলের মতো কর্মসূচি পালন করেন তারা।
ব্যবসায়ীদের ধর্মঘটের কারণে সীমান্ত হাটের ফটক বন্ধ রেখেছিল বিজিবি। এ দেশের ব্যবসায়ীরা বাজারে না বসায় ক্রেতাশূন্য বাজারে আসেননি ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ভারতীয় দোকানগুলোতে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যও বিক্রি হয়। সেগুলো কম দামে কিনে অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি চক্র এ দেশের মুদি ও মনোহরী দোকানে বিক্রি করেন। গ্রামের মানুষ না বুঝেই সেসব পণ্য কিনে ঠকছেন।
এ বিষয়ে ফেনীর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নিয়ম মেনেই হাট পরিচালিত হচ্ছে। হাটের চারপাশের পাঁচ কিলোমিটার এলাকার মানুষের জন্য এ হাটে প্রবেশাধিকার রয়েছে, সেটিও মানা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১৯
এসএইচডি/একে