বরিশাল চামড়াব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদুর রহমান শাহিন বাংলানিউজকে বলেন, গত ৩/৪ বছর ধরে ধারাবাহিক বাজারদর নিম্নমূখী ও ট্যানারি মালিকদের কাছে পাওনা টাকা বকেয়া পড়ে যাওয়ায় স্থানীয়ভাবে ব্যবসায়ীদের অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অনেকে এ ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, চারবছর আগে ঢাকার ট্যানারি ব্যবসায়ীরা বাজারদর মন্দার কথা বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের টাকা আটকাতে শুরু করে। গত কয়েক বছরে বরিশালের ব্যবসায়ীদের টাকা আটকে যাওয়ার পরিমাণ না হলেও তিন কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এ পর্যন্ত শুধু আমিই (শাহিন) প্রায় ৫৬-৫৭ লাখ টাকা পাই ট্যানারি ব্যবসায়ীদের কাছে। আবার এখন ব্যবসা চালিয়ে রাখতে গিয়ে আমি নিজেই ২৬ লাখ টাকার মতো দেনাগ্রস্ত হয়ে রয়েছি।
তিনি জানান, শুরুতে বরিশাল নগরে ২২ জন চামড়া ব্যবসায়ী থাকলে বছরে বছরে কমে তা আটজনে গিয়ে ঠেকেছে। অনেকের টাকা যেমন আটকে গেছে, তেমনি অনেকে দেনাগ্রস্ত হয়ে ব্যবসা চালাতে গিয়ে পথে বসেছেন। চলতি বছরে মাত্র তিনজন ব্যবসায়ী বরিশাল নগরে চামড়া সংগ্রহ করেন। আর যারাও বা করছেন তারা চামড়ার দর না পেয়ে এখন স্থানীয় বাজার থেকে কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। বন্ধ করে দিয়েছেন নিয়মিত গদিতে আসাও। বরিশাল নগরের চৌমাথা বাজারের মাংস ব্যবসায়ী সত্তার সিকদার বলেন, ঈদের পর থেকে পাইকাররা চামড়া নিচ্ছেন না। যাতায়াত খরচা দিয়ে পাইকারদের কাছে পাঠিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। ফলে যাতায়াত খরচটাই বৃথা যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের বাজারসহ আশপাশের বাজারের মাংস ব্যবসায়ীরা সবাই পশুর (গরু) চামড়া কেটে কেটে ব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, গেলো বছরের শেষ থেকে চলতি বছরের ঈদের আগ পর্যন্ত ছয়মাস পশুর চামড়া নিয়েছিল পাইকরারা, তবে কোনো টাকা দেয়নি। আর আগে যেমন চামড়ার আকার আকৃতি দেখে টাকা দেওয়া হতো, এখন তাও করেন না তারা। শুধু বকেয়ার খাতায় সংখ্যা লিখে রাখেন। যদিও ঈদের পর থেকে সব ধরনের চামড়াই সংগ্রহ বন্ধ করে দিয়েছেন পাইকাররা, তাই আমরাও চামড়া ফেলে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।
এ বাজারের মাংসের দোকানে কাজ করা শ্রমিক মানিক জানান, একটা বড় গরুর চামড়া ২ হাজার টাকায়ও বিক্রি করেছি, আর যদি এখন ৫০ টাকাও দেয় তাতে বিক্রি করতে রাজি আছি। কিন্তু কেউ চামড়া নিচ্ছে না।
বরিশাল নগরের পদ্মাবতী চামড়ার পাইকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছর বছর চামড়ার দর কমছে। বিশেষ করে চীনের ওপরে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার পরে এ বাজারে পুরোপুরি ধস নেমেছে। কারণ বাংলাদেশের চামড়া বহু দেশে গেলেও চীন-হংকং এর সবচেয়ে বড় বাজার। তারাই সংগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক বাজারের পরিস্থিতি ঘুরতে হবে। না হলে সরকার রেট নির্ধারণ করে দিলেও ব্যবসায়ীদের কিছু করার থাকবে না।
ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে একটি গরুর চামড়া আকার ভেদে ১ থেকে ৩শ টাকার মধ্যে কেনা হচ্ছে খুচরো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এরপর সে চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে ঢাকায় পাঠাতে আরও ২৩০ টাকা থেকে আড়াইশ টাকা খরচ হয়। যা দীর্ঘ ১ মাসের মতো সংরক্ষণ করে ট্রাকে চাপিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন চামড়ার দর পাওয়া যায় ১৮০ টাকা থেকে ২শ টাকা। আবার সে টাকাও আগের পাওনা বকেয়া টাকার সঙ্গে যোগ হচ্ছে, নগদ কিছুই আসছে না। ফলে স্থানীয় পাইকার কোনোভাবেই চামড়া নিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে না। আর গত কোরবানি থেকেই ছাগলের চামড়া ছোট হওয়ায় তা নিতে অনাগ্রহ ব্যবসায়ীদের। কারণ এর পেছনে শ্রম দেওয়াটাই বৃথা মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
চামড়া ব্যবাসীয় মালিক সমিতির সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদুর রহমান শাহিন জানান, বর্তমানে বাজারে শ্রমিকের মজুরি অনেক বেশি। তারপর যখন ২ হাজার টাকা পর্যন্ত গরুর চামড়ার দর ছিল তখন লবণের বস্তা ছিল ২শ টাকা। আর এখন কমে চামড়ার দাম ২/৩শ টাকায় ঠেকেছে কিন্তু লবণের বস্তার দাম বেড়ে ৮শ টাকা হয়েছে। তাই চামড়ার পেছনে খরচ বেড়েছে। এক্ষেত্রে ধার দেনা করে কোনো ব্যবসায়ী চামড়া কিনতে আগ্রহী নয়, তাই আসন্ন কোরবানিতে কী হবে এটা বরিশালের কোনো ব্যবসায়ীই বলতে পারবে না। যেখানে গতবছর কোরবানিতেও ২০ থেকে ২২ হাজার আর এরআগে ভালো সময়ে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার পিস চামড়া কেনা হতো এ বাজারে।
সমিতির সভাপতি বাচ্চু মিয়া বলেন, প্রতিবছরের মতো কোরবানির আগ মুহূর্তে ট্যানারি ব্যবসায়ীদের কাছে আমরা যাবো। তারা যদি পাওনা বকেয়া টাকা দেয় তাহলে হয়তো স্থানীয় পাইকাররা চামড়া কিনতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪১ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৯
এমএস/এএ