সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিষয়ে জারি করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন, জাতীয় রাজস্ব র্বোড (এনবিআর) এসআরও এবং জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের বিভিন্ন ব্যাংকে পাঠানো নির্দেশনায় এ সংক্রান্ত কিছু উল্লেখ না থাকায় অতিরিক্ত অর্থ গ্রাহক ফেরত পাচ্ছেন না এটা প্রায় নিশ্চিত। কেনার নিয়মে কড়াকড়িসহ উৎস কর বাড়ানোর ঘটনায় ইত্যেমধ্যে আশঙ্কাজনক হারে কমেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি।
অর্থ বিভাগের প্রজ্ঞাপন, এনবিআরএর এসআরও এবং সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের নির্দেশনায় দেখা যায়, পেনশনার সঞ্চয়পত্র ছাড়া সবপ্রকার সঞ্চয়পত্রে ক্রয়কাল নির্বিশেষে পুঞ্জিভুত বিনিয়োগের পরিমাণ ৫ লাখ টাকা অতিক্রম না করলে এরূপ বিনিয়োগ থেকে অর্জিত সুদের ওপর ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিনেন্স ১৯৮৪ এর সেশন ৫২ডি তে উল্লেখিত উৎসে কর কর্তণের হার ১০ শতাংশ হতে হ্রাস করে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে পেনশনার সঞ্চয়পত্রসহ সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ৫ লাখ টাকার উর্ধ্বে হলে আইন অনুযায়ী, উৎসে কর কর্তনের হার হবে ১০ শতাংশ।
এ বিষয়ে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রাজিয়া বেগম বাংলানিউজকে বলেন, গত ২৮ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের প্রজ্ঞাপন ও ২ সেপ্টেম্বর এনবিআর এর এসআরও জারির পর আমরা ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা পাঠিয়ে দিয়েছি। যা গত দুইদিন ধরে সঞ্চয়পত্র ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে। তবে ১ জুলাইয়ের পর পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে অর্জিত মুনাফার ওপর যারা এরইমধ্যে ১০ শতাংশ উৎসে কর দিয়ে ফেলেছেন, তাদের তা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা আসেনি। অর্থবিভাগ বা এনবিআরের জারি করা প্রজ্ঞাপন ও এনআরওতে এ বিষয়ে কোনো বলা হয়নি। তাই মোটামুটি বলা যায়, যারা ১০ শতাংশ হারে টাকা দিয়েছেন পরবর্তী আদেশ না আসা পর্যন্ত আমরা কিছুই করতে পারবো না।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলোচনা করছেন বলে জানান তিনি।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, উৎসে কর কমানোর প্রজ্ঞাপন যখনই জারি হোক না কেন, তা কার্যকর করা হবে ১ জুলাই থেকেই। কিন্তু আইআরডি সূত্রে জানা যায়, ১ জুলাই তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। বরং প্রজ্ঞাপন প্রকাশের তারিখ থেকেই তা কার্যকর। হবে।
অর্থমন্ত্রীর ওই ঘোষণার পরপরই আইআরডি সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া প্রজ্ঞাপন জারির কাজ শুরু করেন। পরে ২৮ আগস্ট গেজেট প্রকাশ হয়।
যোগাযোগ করা হলে আইআরডির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ১ জুলাইয়ের পর পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে অর্জিত মুনাফার ওপর যারা এরই মধ্যে ১০ শতাংশ উৎসে কর দিয়েছেন, তাদের তা ফেরত পাওয়ার আর সুযোগ নেই।
প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই থেকে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপরই উৎসে কর ১০ শতাংশ আরোপ করা হয়েছিল। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হলে গত ২৯ জুলাই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা দেন, পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের মুনাফার ওপর উৎসে করে ৫ শতাংশ করা হবে। তবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ পাঁচ লাখ টাকার বেশি হলে মুনাফার ওপর উৎসে কর ১০ শতাংশই থাকবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিম্ন মধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষ, নারী, প্রতিবন্ধী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের আমানতের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি হওয়ায় গত কয়েক বছর শুধু নিম্ন মধ্যবিত্তরাই নয়, সমাজের উচ্চবিত্ত ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও এর সুবিধাভোগী হয়েছে। এতে অস্বাভাবিকভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি সঞ্চয়পত্র কেনায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয়েছে মাত্র দুই হাজার ১৬০ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৩৩ শতাংশ কম। কর বৃদ্ধি ও সুদ হ্রাসসহ নানা কারণে সঞ্চয়ে উৎসাহ হারাচ্ছে মানুষ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে বিনিয়োগের যেসব বৈধ উৎস রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো সঞ্চয়পত্র খাত। এরপর ব্যাংক, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা, পুঁজিবাজার। যদিও পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সঞ্চয় পরিপন্থি বিভিন্ন নীতি-সিদ্ধান্তের কারণে এসব বৈধ উৎসও ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ফলে বেশি সুদ পাওয়ার প্রলোভনে অবৈধ উৎসে টাকা খাটাচ্ছে অনেকেই।
‘পাশপাশি সঞ্চয়ের একটা অংশ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। এতে নতুন শিল্প-কারখানা যেমন গড়ে উঠছে না, তেমনি কর্মসংস্থানও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই উচ্চ জিডিপি অর্জনে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়াতে সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে। কিন্তু সরকারের নীতিগুলো সম্পূর্ণভাবে সঞ্চয়ের পরিপন্থি,’ যোগ করেন তিনি।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এখাতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এক লাখ টাকার বেশি মূল্যমানের সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এছাড়া নতুন ফরম ও ‘ম্যানডেট’ ফরম সংগ্রহ করে পূরণ করে জমা দিতে হবে। সীমার অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র কেনা ঠেকাতে একটি সেন্ট্রাল ডাটাবেজ করা হয়েছে। এর আগে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৯
জিসিজি/এমএ