কিন্তু বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) হাটে গিয়ে দেখা গেলো উল্টো চিত্র। হাটের জায়গায় জায়গায় পাটের স্তুপ পড়ে থাকলে ক্রেতা নেই।
কারণ লাভের গুড় যখন পিঁপড়ায় খায় তখন লোকসান ছাড়া আর কিছুই থাকে না। রাজশাহীর পাট চাষিদের ক্ষেত্রেও এবার তাই ঘটতে চলেছে। গেল কয়েক বছরের তুলনায় এবার আবাদ ভালো হলেও হাসি নেই পাট চাষিদের মুখে।
পাট লাগানো, পরিচর্যা, কাটা, জাগ দেওয়া, শুকানোর পর বাজারে তুলে দাম পাচ্ছেন না কৃষক। মধ্যস্বত্বভোগীদের অদৃশ্য কারসাজিতে বিক্রির শুরুতেই দাম কমতে শুরু করেছে পাটের। ফলে আশানুরূপ ফলনের পরও এবার স্বপ্নভঙ্গ হতে চলেছে রাজশাহীর পাট চাষিদের।
রাজশাহীর পবা উপজেলার মথুরা গ্রামের পাট চাষি রফিক উদ্দিন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় এবার ছয় বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলনও ভালো হয়েছে।
এছাড়া চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে মাঝেমধ্যেই বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে জলাশয়ে পানি থাকায় এবার পাট জাগ দেওয়া নিয়েও সাধারণ কৃষকদের কোনো বেগ পেতে হয়নি। তবে সমস্যা হচ্ছে, বাজারে এখন পাটের দাম নেই।
তাই অনেকে এখন পাট বিক্রি করছেন না। শুকিয়ে গুদামজাত করে রাখছেন। তবে যাদের গুদামজাত করার জায়গা নেই, রোদ-বৃষ্টিতে বাইরে পড়ে থেকে পাট পচে যাওয়ার ভয়ে তারা বাধ্য হয়ে কম দামেই পাট বিক্রি করে দিচ্ছেন। তা না হলে লাভ তো দূরে থাক পাট পচে পুঁজি হারাবেন তারা। কিন্তু পাটের দাম পড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরাও ভিড়ছেন না। এতে বেচাকেনা এখনও জমে ওঠেনি।
নজরুল ইসলাম নামে পবার পিল্লাপাড়া গ্রামের অপর পাটচাষি বাংলানিউজকে বলেন, বাজারে দাম ও ক্রেতা দু'টোয় কম। মোক্ষম এ সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদের বুদ্ধি ও পুঁজি খাটিয়ে কৃষকদের ঘর থেকে এ পাট কম দামে কিনে নিচ্ছেন। রাখছেন গুদামজাত করে। বাজারে যখন সব পাট শেষ হয়ে যাবে তখন তারা বেশি দামে এ পাট বিক্রি করে বারতি মুনাফা লুটবেন।
নজরুল ইসলাম বলেন, খাদ্যশস্যে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সরকারি ঘোষণার পর বাজারে পাটে চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু সরকার পাটের দাম নির্ধারণ করে না দেওয়ায় বাজারে শৃঙ্খলা ফেরেনি। কৃষকের সোনালি ফসল নিয়ে তাই মুনাফালোভীরা ছিনিমিনি খেলে।
তারা নিজেদের সুবিধা বুঝে বাজারে কখনও দামের পতন ঘটায় কখনও আবার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাড়তি লাভ আদায় করে। মাঝখানে পড়ে কষ্টটা করে কৃষক। আবার ক্ষতিগ্রস্ত হন ওই কৃষকই। তাই পাটচাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়াতে এবং সোনালি আঁশের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে এর দাম বেঁধে দেওয়ার দাবি জানান এ কৃষক। পাটচাষি জহির উদ্দিন বলেন, পাটের আবাদে একজন কৃষককে বিঘায় প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। আর বিঘায় পাট উৎপাদন হয়েছে ৮ থেকে ১০ মণ। এখন ভরা মৌসুম। চাষিরা রাজশাহীর বিভিন্ন হাট-বাজারে পাট বিক্রি শুরু করেছেন। অথচ গত বছরের তুলনায় এবার হাট-বাজারে পাটের দাম মণ প্রতি প্রায় ৫শ’ টাকা কম। ফলে গত বছরের দাম দেখে যারা এবার পাট চাষ করেছেন তাদের মাথায় হাত পড়েছে। পাট নিয়ে হতাশায় দিন কাটছে তাদের।
এদিকে, রাজশাহীর পবা ছাড়াও প্রতিটি উপজেলার হাট-বাজারে এখন পাটের দামের একই অবস্থা। বিভিন্ন হাট-বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে এবার বাজারে ১ হাজার ৮শ’ থেকে ১ হাজর ৯শ’ টাকা দরে প্রতিমণ পাট বিক্রি হয়েছে। এটা উন্নত মানের পাট। আর বৃহস্পতিবার তা বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৫শ’ টাকা থেকে ১ হাজার ৬৫০ টাকায়।
কোনো কোনো উপজেলা এলাকায় এর চেয়েও কম দামে পাট বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত মৌসুমে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ১শ’ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। ফলে এবার মণ প্রতি পাটের দাম কমেছে প্রায় ৫০০ টাকা। মধ্যসত্বভোগী ও বেসরকারি পাটকল মালিকরা সিন্ডিকেট করে পাটের দাম কমিয়ে পাট কিনে নিচ্ছে। এ সিন্ডিকেট না ভাঙতে পারলে এবার কৃষকরা পাটের দাম আরও বেশি হতো।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এবার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার বেশি পাটের আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ হাজার ৫৭৫ হেক্টর। চাষ হয়েছে ১৩ হাজার ৮৪৬ হেক্টর। ফলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৭১ হেক্টর বেশি জমিতে পাট হয়েছে। যেখান থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার ৫৭৭ বেল (১ বেল সমান প্রায় ৫ মণ বা প্রায় ১৮৭ কেজি)। রাজশাহীতে গতবার চাষ হয়েছিল ১২ হাজার ৮২৫ হেক্টর।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফরের উপ-পরিচালক শামছুল হক বলেন, পাট চাষে অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করায় এবার আবাদ ভালো হয়েছে। উৎপাদনও ভালো হয়েছে। তবে ধান-চাল ও গমের মতো পাটের দর নির্ধারিত নেই। এটি থাকলে কৃষকরা ন্যায্য দাম পেতেন। তবে দাম মির্ধারণের বিষয়টি সরকারের ব্যাপার। এখনকার যেই বস্তবতা তা দেখে সরকার অবশ্যই বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে। আর দাম ভালো পেলে ফের সোনালি আঁশের সুদিন ফিরবে। আগামীতে আরও বেশি পাটের আবাদ হবে বলেও মন্তব্য করেন এ কৃষি কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯
এসএস/ওএইচ/