ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, ২০০৭ সালের এক-এগারোর ঘটনার পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বন্দরে কার্গোর চাপ অন্তত দ্বিগুণ বেড়েছে। কিন্তু এই সময়ে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হয়েছে।
বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক-এগারোর আগের অরাজক পরিস্থিতিতে যেন ফিরে যেতে চলেছে চট্টগ্রাম বন্দর। ওই সময় সংস্কারের ফলে বন্দরে পণ্য ওঠানো-নামানোর ক্ষেত্রে যে ধরনের নীতিমালা গ্রহণে স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা এসেছিল, সাম্প্রতিক সময়ে তার যেন ব্যত্যয় ঘটে চলেছে।
তারা বলছেন, বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে মোংলা বন্দরের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য নিচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্য খালাস করতে গেলে সেখানেও বিড়ম্বনায় পড়তে হয় আমদানিকারকদের। জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করতে গিয়ে মালপত্র নষ্ট করা এবং বিলম্বে পণ্য খালাস করায় বিদেশি মুদ্রায় ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে, যার ফলে আমদানিকারকদের লোকসানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, জাহাজে করে বিদেশ থেকে আনা পণ্য খালাসে যারা বহির্নোঙরে কাজ করে তাদের ‘শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর’ বলে। দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলোর রয়েছে নিজস্ব অপারেটিং ব্যবস্থা। তারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মালপত্র খালাস করে। এতে তাদের পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং অর্থ সাশ্রয় হয়।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, শিপিং এজেন্ট চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসার ঘোষণা দেওয়ার পরই হ্যান্ডলিং অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন তাদের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ বরাদ্দ দেয়। এক্ষেত্রেই রয়েছে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্য মতে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ৩২টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর কাজ করছে। এর আগে ‘নন রেসপন্স’ তালিকাভুক্ত হওয়া ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছয়টি এরই মধ্যে আদালতে রিট করেছে। তিনটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে আদালতের নির্দেশনায় কাজ শুরু করেছে। অন্য তিনটিকে কাজ শুরুর জন্য আদালত অনুমতি দিলেও আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ায় তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে।
অথচ বন্দরের স্টেকহোল্ডাররা বলছেন, সব ক’টি অপারেটরকে কাজ করতে দিলে চট্টগ্রাম বন্দরের গতিশীলতা আরও বাড়তো।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দাবি, অপেক্ষমাণ বা বাদ পড়া ১৩টি কোম্পানি বছরে ন্যূনতম পাঁচ কোটি টাকা আয়বঞ্চিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গত তিন বছরে তাদের অন্তত ৩২৫ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর এ হক চৌধুরী অ্যান্ড সন্সের ম্যানেজার ইকবাল করিম চৌধুরী সম্প্রতি জানান, ইতোমধ্যে একাধিক প্রতিষ্ঠানে আইনি নির্দেশনা পেলেও বারবার আপিলের কারণে সুযোগবঞ্চিত হচ্ছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরগুলো। তার প্রতিষ্ঠান মোংলায় কাজ করতে পারলেও চট্টগ্রাম বন্দরে পারছে না বলে তিনি জানান। ২০১৫ সাল থেকে চলতি সময় পর্যন্ত নানা কৌশল করে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন বড় শিল্প গ্রুপগুলোকে হয়রানি ও বিড়ম্বনায় ফেলেছে। এরই মধ্যে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে কাজের সুযোগ না পাওয়া শিপ হান্ডলিং অপারেটররা।
গত আগস্টে শিপ হান্ডলিং অপারেটর মমতাজ শিপিং এজেন্সির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে ন্যূনতম ২০ শতাংশ গ্রোথের বিবেচনায়ও অপারেটরদের উন্মুক্ত করে দেওয়া প্রয়োজন। এতে সামগ্রিকভাবে বন্দরের গতিশীলতা বাড়বে। লাভবান হবে দেশ। ’
তিনি অ্যাসোসিয়েশনের প্রভাব বিস্তারের বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে চট্টগ্রাম বন্দরের আইন কর্মকর্তা মুনতাসির আহমেদ বিচারাধীন ও নির্বাহী বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা জানান। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন্দর-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আপিলের বিষয়টি নির্ভর করে ঊর্ধ্বতন সিদ্ধান্তের ওপর। যে মামলায় বেনিফিট পাওয়া যায় বলে ধারণা করা হয়, সেটিতেই কৌঁসুলি নিয়োগসহ আপিলের সিদ্ধান্ত আসে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে সম্প্রতি বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম সামসুজ্জামান রাসেল বলেন, ‘শিপ হান্ডলিং বরাদ্দ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে অ্যাসোসিয়েশনের হস্তক্ষেপ বা যোগসাজশের কোনো অভিযোগ সত্য নয়। তাছাড়া চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের দর বিভক্তির বিষয়টিও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও মোংলা অ্যাসোসিয়েশনের নিজস্ব। ’ সেখানে অ্যাসোসিয়েশনের নির্দিষ্ট দর থাকলেও কেউ কেউ তার চেয়ে কম দরেও কাজ করে বলেও জানান তিনি। তার দাবি, বড় শিল্প গ্রুপগুলোর নিজের কাজ নিজে করার কোনো নীতিমালা বন্দরের শিপ হান্ডলিংয়ের নিয়মে নেই।
তবে তার এ দাবি নাকচ করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, শীর্ষ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের কাজ নিজেরা করার জন্য বহু আগেই হাইকোর্ট থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছে।
সূত্র জানায়, অ্যাসোসিয়েশনের প্রভাবের বিষয়টি অমূলক নয়। যারা প্রাথমিক পর্যায়ে তালিকাভুক্ত হননি, পরে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের বিষয়ে পূর্বতনরা অভিযোগ করতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আপত্তির কোনো কারণ নেই। কেননা শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর ৩০টির জায়গায় যদি ৫০টি হয়, সেক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরেরই লাভবান হওয়ার কথা। কারণ এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও কাজে গতিশীলতা আসে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৯
এইচএ/