জানা যায়, ভারত সীমান্তবর্তী বরকল উপজেলার ঠেগামুখে স্থলবন্দর নির্মাণের এ প্রস্তাবনাটি এখন পর্যন্ত বক্তৃতা, বিবৃতি আর সেমিনারে আলোচনাতে রয়ে গেছে। বাস্তবে এ কাজের সূচনা এখনো হয়নি।
ঠেগামুখ বাজারের ব্যবসায়ী সুশীল চাকমা বাংলানিউজকে বলেন, জন্মলগ্ন থেকে এ এলাকায় বাস করছি। শুনেছি সরকার এ এলাকায় একটি স্থলবন্দর নির্মাণ করবে। অনেক বছর পার হয়ে গেল তবে এখনও বন্দরটি নির্মাণ হয়নি। এখানে বন্দর হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
একই বাজারের আরেক ব্যবসায়ী জনতা দেবী চাকমা বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের এলাকায় বন্দর নির্মাণ হবে শুনে আসছি অনেক বছর ধরে। এখন মোটামুটি ব্যবসা করছি। তবে বন্দর হলে আরও ভাল হবে।
‘ঠেগামুখ’ এর পশ্চিমে বাংলাদেশ আর পূর্ব পাশে ভারতের মিজোরাম প্রদেশ। দুই দেশের সঙ্গে চমৎকার বন্ধুত্ব থাকায় এ সু-সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ-ভারত ব্যবসায়িক যোগাযোগ বাড়াতে ওই এলাকায় একটি স্থলবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এ লক্ষে ২০১৩ সালের ৩০ জুন ঠেগামুখ স্থলবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০১২ সালে ঠেগামুখ স্থলবন্দরের সম্ভাব্যতা সরেজমিনে দেখার জন্য এডিবি’র পাঁচ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি দল ঠেগামুখ পরিদর্শন করেন। এছাড়া নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান এবং অত্র মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঠেগামুখ পরিদর্শন করেন বলে জানা গেছে। এরপর সরকার স্থলবন্দর নির্মাণের জন্য ২৪৭ একর জায়গা নির্ধারণ করে।
এর আগে, ঠেগামুখ স্থলবন্দর নির্মাণের লক্ষে ২০০৫ সালে ভারতের মিজোরাম প্রদেশীয় সরকারের পক্ষ থেকে সেদেশের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হলে ২০০৬ সালে এ সংক্রান্ত একটি সম্ভাব্যতা জরিপও চালানো হয় ভারতের পক্ষ থেকে। স্থল বন্দরটিকে কেন্দ্র করে দু’দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সড়ক পথের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
সরকারের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ঠেগামুখ স্থলবন্দর নির্মাণে জমি নির্বাচন করা হলেও আইন জটিলতায় অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ঠেগামুখ স্থলবন্দরের জন্য সম্ভাব্য স্থানটি পাহাড়ি ও দুর্গম। ভারতীয় অংশের সঙ্গে ঠেগামুখ স্থলবন্দরের সঙ্গে সড়কপথে কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌ-পথ। তাই বাংলাদেশ-ভারতকে ভাগ করা প্রবাহিত সরু ঠেগাখাল (কাপ্তাই হ্রদ) যেটি বান্দরবানের থানচি উপজেলা দিকে চলে গেছে সেই খালের উপর ১০০ মিটারের একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হলে দু’দেশের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ সহজেই স্থাপন সম্ভব হবে।
এদিকে, ঠেগামুখ বা ঠেগা বন্দরের (বরকল উপজেলা) সঙ্গে রাঙামাটি জেলা সদরের দূরত্ব নদী পথে প্রায় ১৩০-১৫০ কিলোমিটার। এ রুটে সড়ক বিভাগে যোগাযোগ করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রাঙামাটি জেলা সদর হয়ে বরকল উপজেলার ঠেগামুখ পর্যন্ত ১২৬ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা প্রয়োজন হবে। এর মধ্যবর্তীস্থানে একটি নদীর ওপর ব্রিজও নির্মাণ করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ঠেগামুখে প্রস্তাবিত স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠা এবং একইসঙ্গে মিজোরামের সঙ্গে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে সম্ভাব্য তিনটি রুট বিবেচনা করা হচ্ছে। এরমধ্যে ঠেগামুখ থেকে বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার সড়ক স্থাপনেরও বিকল্প পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া ঠেগামুখ থেকে বরকলের আইমাছড়া, জুরাছড়ি উপজেলা, বিলাইছড়ি উপজেলা এবং কাপ্তাই উপজেলা পর্যন্ত প্রায় ১৫০ কিলোমিটারের সড়কটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে ঠেগামুখ থেকে বাঘাইছড়ি সড়কটি অধিক উপযোগী।
মহিলা সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু বাংলানিউজকে বলেন, ঠেগামুখ স্থলবন্দর আমাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক একটি উপহার। বন্দরটি হলে আমাদের জীবনমানের যেমন পরিবর্তন হবে তেমনি উভয়ই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য জমে উঠবে। তবে সরকারি নানা জটিলতায় কার্যক্রমটি বন্ধ থাকায় আমরা দুশ্চিতায় পড়েছি।
তিনি আরও বলেন, পুরো এলাকাটি এখন সন্ত্রাসীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। বন্দরটি স্থাপিত হলে এই এলাকা থেকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। এখন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঠেগামুখ স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করা গেলে যোগাযোগের পথ সুগম হবে এবং দুর্গম এলাকাগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে। বন্দরটির কার্যক্রম যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে শুরু করা যায় সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সর্বোচ্চ সুপারিশ করা হবে।
রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের সভাপতি বেলায়েত হোসেন ভুঁইয়া বাংলানিউজকে বলেন, ঠেগামুখ স্থলবন্দর নির্মাণ নিয়ে আমরাও হতাশায় ভুগছি। বর্তমান সরকার কর্তৃক ঘোষণা দেওয়ার দীর্ঘদিন পার হওয়ার পরও বন্দরটির নির্মাণ না হওয়ায় আমাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তথা আমাদের ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন অধরা থেকে যাচ্ছে। তবে আমরা হাল ছাড়ছি না। সরকারের সঙ্গে আমরাও বন্দরটি নির্মাণে স্থানীয় প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যতো দ্রুত সম্ভব বন্দরটি হলে পিছিয়ে পড়া রাঙামাটি জনপদ অর্থনৈতিকভাবে নতুন ক্ষেত্রের সঙ্গে যোগ দিতে পারবে।
রাঙামাটি নৌ-পরিবহন ও বাস মালিক সমিতির সভাপতি মঈন উদ্দীন সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, ঠেগামুখ স্থলবন্দর নির্মাণ কখন হবে তা নিয়ে আমরা মুখিয়ে আছি। বন্দরটি নির্মাণ না হওয়ায় আমাদের ব্যবসায়িক নতুন পথ স্থবির হয়ে পড়ে আছে। যদি বন্দরটি নির্মাণ করা যায় তাহলে আমাদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম নৌ ও বাস পরিবহন ব্যবসায় অর্থনৈতিক নতুন ক্ষেত্র যোগ হবে।
রাঙামাটি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আল হক বাংলানিউজকে বলেন, সরকার যখন রাঙামাটিতে একটি স্থলবন্দর নির্মাণের ঘোষণা দেয় তখন আমরা অনেক খুশি হয়েছিলাম। ভাবলাম এবার পিছিয়ে পড়া জনপদটি অর্থনৈতিকভাবে আলোর মুখ দেখবে। কেননা ঠেগামুখ স্থল বন্দরটি রাঙামাটিবাসীর জন্য একটি গুরুত্বপর্ণণ সম্পদে পরিণত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যর বিষয় সরকারি নানা জটিলতায় বন্দরটির কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় আমরা ব্যথিত হয়েছি। এ সরকারের মেয়াদকালীন দ্রুত সময়ের মধ্যে বন্দরটি নির্মাণের কাজে হাত দেয় তাহলে রাঙামাটি মানুষের হতাশা কেটে যাবে, মিলবে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক মুক্তি।
বরকল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিধান চাকমা বাংলানিউজকে বলেন, ঠেগামুখে স্থলবন্দর নির্মিত হবে অনেক আগে থেকে শুনে আসছি। তবে এ বন্দর হলে জনগণের কি লাভ হবে তা বোধগম্য নয়। আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও দরিদ্র মানুষ রয়েছে। তবে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্তাদের সঙ্গে যদি পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বন্দরটি নির্মিত হয় তবে ভাল।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৯
এনটি