কম খরচে বেশি লাভ এবং টেকসই জাতের ‘ভেনামি’ চিংড়ি চাষের দাবি ছিলো রপ্তানিকারক ও চিংড়ি চাষীদের। কারণ এ চিংড়িই এখন বিশ্ববাজারের ৭৭ শতাংশ দখলে নিয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের খুলনার পাইকগাছা নোনা পানি গবেষণা কেন্দ্রের তিনটি পুকুর ব্যবহারের জন্য তাদের দেওয়া হয়। সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয় প্রতিটি ধাপে অনুমতি নেওয়ার শর্ত।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের আগস্টে ভেনামি প্রজাতির চিংড়ি চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং নতুন প্রজাতির ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ে সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা ভেনামি চিংড়ি চাষের জন্য সমন্বিত উদ্যোগের সুপারিশ করে। এর মধ্যে রয়েছে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, জৈব নিরাপত্তা, হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা, পোনা আমদানি, উৎপাদন এবং সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া। পরীক্ষামূলক চাষের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ব্যাপকভিত্তিক উৎপাদনে যাওয়ার বিষয়ে কমিটি সুপারিশ করে। কমিটি চিংড়ির রেণু উৎপাদন বাড়ানোর জন্য স্থানীয় কিছু হ্যাচারিকে জীবাণুমুক্ত পোনা আমদানির অনুমতি দেওয়ারও সুপারিশ করে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী এশিয়ার অনেক দেশে বিদেশি রোগের আমদানি ঘটবে এমন আশঙ্কায় ভেনামি প্রজাতির চিংড়ি চাষের বিরোধিতা করা হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতি (বিএফএফইএ) ইতিবাচক যুক্তি তুলে ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অনেক দিন থেকেই ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনের বিষয়ে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে।
এদিকে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন নিজস্ব অর্থায়নে পুকুর কেটে ব্যবহারের উপযোগী করে। দীর্ঘ ৬ মাস ভেনামি চিংড়ির পোনা আনার জন্য মৎস্য অধিদপ্তরে অনুমতির আবেদন করে বসে আছে। অন্যদিকে মাসের পর মাস অতিবাহিত হওয়ার কারণে পুকুর আবার ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পাইলট প্রকল্পে প্রাথমিক পদক্ষেপও ভেস্তে যাচ্ছে।
জানা গেছে, ভেনামি চিংড়ি প্রথম ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পরিচিতি পায়। ১৯৮০ সালের দিকে এই প্রজাতির বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। এরপর থেকে চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং ভারতের মতো এশিয়ার অনেক দেশে ব্যাপকভিত্তিক চাষ শুরু হয়।
মৎস্যখাত উন্নত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে যুক্তরাজ্যের শীর্ষ খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানি ‘সিমার্ক’। ২০০০ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামে সামুদ্রিক খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করে তারা এবং ব্রিটিশ রাজকুমারি অ্যান সেটির উদ্বোধন করেন।
একসময় বাংলাদেশে সামুদ্রিক খাদ্য উৎপাদন এবং রপ্তানিতে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে সিমার্ক। ব্ল্যাক টাইগার এবং স্বাদু পানির চিংড়ি রপ্তানিতে সাফল্যের কারণে তারা বিভিন্ন পুরস্কারও জেতে।
বাজারে ভেনামি নামে নতুন প্রজাতির সাদা চিংড়ি আসায়, গত ১০ বছর ধরে ব্ল্যাক টাইগারের চাহিদা কমতে শুরু করে।
২০১২ সালে ব্ল্যাক টাইগার এবং স্বাদু পানির চিংড়ি রপ্তানি করে বাংলাদেশের মোট আয় হয়েছিল ৫৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ২০১৯ সালে মোট আয় হয় ৩৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ সময়ের মধ্যে ৮৫ শতাংশ চিংড়ি কারখানা উচ্চ ঋণে জর্জরিত হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে বা উৎপাদন থেমে গেছে।
এদিকে গত ১৫ বছর ধরে ভেনামিই চাষ করছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও চীন। এসব চিংড়ি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, রাশিয়া, আফ্রিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং মধ্য প্রাচের কয়েকটি দেশে রপ্তানি করছে তারা। বিশ্বজুড়ে ভেনামি চিংড়ির বাৎসরিক বাজার মূল্য ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বহু আলাপ-আলোচনা হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এবং যথাযথ নেতৃত্বের অভাবে বাংলাদেশে ভেনামির চাষ শুরু করা যাচ্ছে না।
মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় অফিস সূত্রে জানা যায়, খুলনা বিভাগের ১০ জেলার ৪টি জেলায় ‘সাদা সোনা’ খ্যাত বাগদা চিংড়ির চাষ হয়। এর মধ্যে খুলনায় ৩২ হাজার ৮শ’ ৯৬.০২ হেক্টর জমিতে ২০ হাজার ৪৩০টি ছোট বড় বাগদা চিংড়ি ঘের, সাতক্ষীরায় ৬৬ হাজার ৮৩২ হেক্টর জমিতে ৫৪ হাজার ৯৩২টি ঘের, বাগেরহাটে ৫১ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে ৩৫ হাজার ৬৮২টি ও যশোরের ৭ শ’৫৮ হেক্টর জমিতে ৮৯৩টি ঘের রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের মৎস্য মন্ত্রণালয়ের আন্তরিক চেষ্টায় ভেনামি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশে ক্রমান্বয়ে বিকাশ ঘটবে ভেনামি চিংড়ি চাষের। আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের চিংড়ি শিল্প প্রাণ ফিরে পাবে এবং রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়বে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত হিমায়িত চিংড়ি শিল্পে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আশির দশকের লাভজনক এ খাতটি আজ লোকসানি শিল্পে রূপ নিয়েছে। বিশ্ববাজারে কমেছে চিংড়ির চাহিদা। খুলনায় রপ্তানির জন্যে মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ ৫৯টির কারখানার মধ্যে চালু আছে মাত্র ২৩টি কারখানা।
বাগেরহাট জেলার মোংলার চিলা ইউনিয়নের সুন্দরতলা গ্রামের ঘের মালিক বিজন বৈদ্য বাংলানিউজকে বলেন, চিংড়িতে ভাইরাসের আক্রমন ঘটায় গত কয়েক বছর হাজার হাজার ঘেরের চিংড়ি মরে গেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বৃহত্তম খাত চিংড়িতে মড়ক শুরু হওয়ায় সম্ভাবনাময় এ শিল্পের সাথে জড়িতরা অনেকেই পথে বসে গেছেন। শুনেছি ভেনামি চিংড়ি চাষে খরচ ও দাম কম আর উৎপাদন বেশি হওয়ায় বিশ্বের অনেক দেশ এ চিংড়ি চাষ করছে। কাজেই বিশ্ববাজারে আবারো বাংলাদেশের অবস্থান পোক্ত করতে বাগদার পাশাপাশি ভেনামি চিংড়ি চাষ শুরু করা যেতে পারে।
খুলনা বিভাগীয় চিংড়ি পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া রিপন বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্বব্যাপী বাগদার স্থান দখল করে নিচ্ছে ভেনামি। বাগদা চিংড়ির উৎপাদন হেক্টরপ্রতি তিন থেকে ছয় হাজার কেজি। অন্য দিকে ভেনামি বা সাদা চিংড়ি উৎপাদিত হয় ১০ থেকে ৩০ হাজার কেজি। চিংড়ির বিশ্ববাণিজ্যে ৭৭ শতাংশ দখল করে আছে ভেনামি। বাংলাদেশে ভেনামি চিড়িংর পাইলট প্রকল্পই আলোর মুখ দেখছে না। পাইকগাছার নোনা পানি গবেষণা কেন্দ্রে ভেনামি চাষের উদ্যোগ নেওয়ায় আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম। আমরা জানি বিশ্ব বাজারে এ চিংড়ির চাহিদা অনেক। কিন্তু কিভাবে এর চাষ করতে হয় এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এ অঞ্চলে ভেনামি চিড়িংর পাইলট প্রকল্প যদি আলোর মুখ দেখতো তাহলে আমরা লাভবান হতে পারতাম। বিগত বছরগুলোতে চিংড়ি চাষীরা ভাইরাসের কারণে লোকসানে পড়েছে। আর বিশ্ববাজারে দর পতনে এ শিল্পই এখন মৃত প্রায়।
তিনি সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন ভেনামি চাষ প্রকল্পটি যেন অতি দ্রুত আলোর মুখ দেখে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ভেনামি চিংড়ি চাষের জন্য নিজস্ব টাকায় পুকুরের মাটি কাটা হয়েছে। এর প্রতিটি পদক্ষেপে সরকারের কাছে অনুমতি নিতে হয়। একদিনে অনুমতি দিয়ে দেয়নি যে তোমাদের অনুমতি দিলাম, তোমরা চাষ করো। সরকারের একটি কমিটি আছে। সেই কমিটি দেখে দেখে অনুমতি দেয়। সেই কমিটির সদস্যরা মিটিংয়ের জন্য তিন মাসের আগে এক হতে পারে না। পোনা আনার জন্য ৬ মাস আগে অনুমতি চেয়েছি। এখনও পাইনি। শুনেছি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। তাদের গবেষক ও গবেষণা রয়েছে, মাছ নিয়ে গবেষণা করেন তারা। আর নতুন একটি প্রজাতিকে উৎপাদন করতে আমাদের দায়িত্ব দিয়েছে। আসলে তারা দায় এড়াচ্ছে। এটা বিশ্ববাজার দখল করছে। অনেক দেশ এটা চাষ করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করছে। আর আমরা এখনও শুরুই করতে পারলাম না।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবু সাঈদ বাংলানিউজকে বলেন, ভেনামি নামের সাদা চিংড়ি চাষের পদক্ষেপ নিয়েছিলো সরকার। এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য খুলনার পাইকগাছায় নোনা পানি গবেষণা কেন্দ্রেকে তিনটি পুকুর দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনকে এ দায়িত্ব দেয় সরকার। দীর্ঘ দিন ধরে তারা ভেনামি চাষের দাবি করছিলো। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো। মৎস্য অফিস তাদের সহযোগিতার জন্য এগিয়েছিলো কিন্তু ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন না আগানোর জন্য ভেনামি চাষ প্রকল্প সামনের দিকে আর এগোয়নি।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০২০
এমআরএম/এজে