ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

বন্যা-মহামারি-দরপতন: আবারও চামড়া নষ্ট হওয়ার শঙ্কা

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৩ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২০
বন্যা-মহামারি-দরপতন: আবারও চামড়া নষ্ট হওয়ার শঙ্কা ...

ঢাকা: দেশে চলমান বন্যার প্রভাব, করোনাভাইরাস মহামারি, রপ্তানিতে মন্দা, আড়তদারদের আর্থিক সংকটের কারণে এ বছরও কোরবানির পশুর চামড়ার দরপতন ও নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, চলমান করোনাভাইরাস আর বন্যায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এবার গত বছরের চেয়ে পশু কোরবানি ৪০ শতাংশ কম হবে।

আর বন্যার জন্য সঠিক সময়ে চামড়া সংরক্ষণ করা যাবে না। এর সাথে যোগ হয়েছে আড়তদারদের আর্থিক সংকট। ফলে এ বছরও চামড়ার দরপতন হবে। আর গতবারের চেয়ে বেশি চামড়া নষ্ট হবে। যদিও সরকার রপ্তানির সুযোগ দেয়াসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু উদ্যোগগুলো আরো আগে নেয়া প্রয়োজন ছিল মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত বছর আড়তদারদের কাছে ‘ন্যায্য মূল্য’ না পেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় ও আবর্জনার ভাগাড়ে চামড়া ফেলে গিয়েছিলেন ফড়িয়ারা। এ বছর বিশ্ববাজারে চামড়ার দরপতন ও দেশীয় শিল্পগুলোর সক্ষমতা কমে যাওয়ায় ঢাকার জন্য গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত বছর ঢাকায় ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। অন্যদিকে, খাসির চামড়া সারাদেশে প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা ও বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর খাসির চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা ও বকরির চামড়া ১৩ থেকে ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।

এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, করোনা ও বন্যাসহ সার্বিক দিক বিবেচনায় এ বছরও চামড়ার বাজার নিয়ে অস্থিতিশীলতার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এ বছর গত বছরের থেকেও চামড়ার দাম কমে যাবে ও অনেক চামড়া নষ্ট হবে। কারণ এই খাত পুরাটাই টাউটদের হাতে চলে গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে রপ্তানির ঘোষণা দিয়েছে তা আরো আগে দেয়া উচিত ছিল। এ বছর রপ্তানি না করলে চামড়ার দাম পাবে না। এ জন্য আমাদের সকল বর্ডার খুলে দিতে হবে চামড়ার জন্য। যদি পাচারও হয় তাও ভালো। তারা তো ফ্রি নেবে না। এতে করে চামড়া পচে যাবে না, ন্যায্য দাম পাবে।

তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীরা মিলে বিশ্ববাজারে চাহিদা তৈরি করতে এখন থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এখন বাজারে যে সিন্ডিকেট আছে আর বিকল্প হিসেবে একটি রপ্তানি সিন্ডিকেট তৈরি করতে হবে তাহলে বাজারে দাম পাওয়া যাবে। চামড়া রপ্তানি সহজ করতে হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, দেশে চামড়া সংগ্রহে কোন শৃঙ্খলা নেই। প্রথমে সেখানে শৃঙ্খলা আনতে হবে। মৌসুমি ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেট চামড়ার দাম নিয়ে সমস্যা তৈরি করে। এজন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। এখাতে স্থায়ী সমাধানে যেতে হলে পূর্ব পরিকল্পনা নিতে হবে, সরকার ধান চাল যেভাবে কেনে সেরকম পরিকল্পনা নিতে হবে।

তিনি বলেন, সরকার এ বছর রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু আরো আগে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন ছিল। তবে চলমান বন্যা, করোনা, আড়কদারদের আর্থিক সংকটের কারণে এ বছরও আমাদের চামড়ার দাম কম হবে ও নষ্ট হবে।

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এ বছর কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তারপরও চ্যালেঞ্জ কাটেনি। দাম কমে যাওয়া ছাড়াও এবার অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মহামারিতে তো সব কাজেই বাধা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে গেলে এই চামড়াগুলো কীভাবে সংরক্ষণ করব? যাই বলি, ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকদের কাছে প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা পাবেন আড়কদাররা। ইতোমধ্যে অ্যাসোসিয়েশনের কাছে ১৫৩ কোটি টাকার একটা হিসাব এসেছে। গত বছরও লেনদেন বাবদ ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে রয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা প্রায় ৫০ কোটি টাকা পেয়েছি। ফলে আড়তগুলোতে নগদ অর্থ না থাকলে চামড়া ক্রয় করবে কীভাবে? আর আড়তদাররা চামড়া না নিলে তখন একদল মৌসুমি ব্যবসায়ীর সৃষ্টি হয়। তারা বাজারটাকে হ য ব র ল করে ফেলে।

আফতাব হোসেন বলেন, গত বছর মাঠ পর্যায় থেকে সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করতে গিয়ে মুনাফা না পেয়ে চামড়া ফেলে দিয়েছেন, মাটির নিচে পুঁতে ফেলেছেন অনেকেই। এ জন্য এ বছর যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তার থেকে ৫/৭ টাকা কমিয়ে ফড়িয়ারা চামড়া কিনলে তাহলেই তারা কিছুটা মুনাফা করতে পারবেন। ফড়িয়াদের কোনোভাবেই ৩০ টাকার ওপরে যাওয়া উচিত হবে না বলে মনে করেন তিনি।

৩১ বছর পর এ বছর সরকার কাঁচা চামড়ার রপ্তানির সুযোগ দিয়েছে জানিয়ে আফতাব হোসেন বলেন, সরকার হোয়াইট ব্লু এবং কাঁচা চামড়া রপ্তানি উন্মুক্ত করলেও তার সুফল তাৎক্ষণিক পাওয়া যাবে না। কারণ পুরো বিশ্ব জানে যে বাংলাদেশ থেকে কাঁচা চামড়া কিংবা হোয়াইট ব্লু  রপ্তানি হয় না। তাহলে হঠাৎ করেই এই চামড়ার বাজার ধরা সহজ হবে না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ট্যানারি মালিকরা তাদের সারা বছরের চাহিদার অর্ধেক চামড়া কিনে থাকেন এই কোরবানির মৌসুমে। কিন্তু গত ছয় মাসে আমাদের কোনো চামড়াই বিক্রি হয়নি। আমাদের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার চামড়া মজুত রয়েছে। ফলে এবার ট্যানারিগুলোতে চামড়ার চাহিদা কম থাকবে। অনেক ট্যানারি মালিক চামড়া কিনতে চাইবে না। স্বাভাবিক কারণেই গত বছরের চেয়ে এবার চামড়ার দাম কম হবে। তবে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে কাঁচা চামড়া কিছুটা রপ্তানি হবে। কিন্তু বন্যার জন্য সংরক্ষণে সমস্যা হবে। এজন্য তিনি ফড়িয়া ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের চামড়া সংরক্ষণ করে সাথে সাথে লবণ দেয়ার পরামর্শ দেন।

চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববাজারে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় ট্যানারিগুলোতে চামড়ার চাহিদা কমেছে। বিশ্ববাজারেও চামড়ার দাম পড়তির দিকে। যেখানে প্রতি বর্গফুট ফিনিশড লেদার দুই ডলারের উপরে হাতবদল হতো, এখন তা এক ডলারেরও নিচে নেমে গেছে। এখন ৭০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকার মধ্যে যেসব গরু বিক্রি হচ্ছে, ওই সব গরুর চামড়ার আয়তন দাঁড়াচ্ছে ২০ থেকে ৩০ বর্গফুট। প্রতি বর্গফুট ৩০ টাকা ধরলে কোরবানিদাতার কাছ থেকে ফড়িয়ার কাছে ২০ বর্গফুটের এই চামড়া যাবে ৬০০ টাকায়। এই ফড়িয়া প্রতি বর্গফুট ৩৫ টাকায় বিক্রি করতে পারলে কিছুটা লাভের মুখে দেখবেন।

সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, সরকার নির্ধারিত দামে ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনবেন। চাহিদামতো ঋণ বিতরণসহ এ খাতের ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, এবার কোরবানির চামড়া নষ্ট হবে না। কোরবানির দিন সারাদেশে চামড়া কেনাবেচার বিষয়টি মনিটরিং করা হবে। এজন্য তদারকি টিম কাজ করবে।

এদিকে চামড়া সংরক্ষণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কোরবানির কাঁচা চামড়া সরকার নির্ধারিত মূল্যে কেনাবেচা ও সংরক্ষণে কমপ্রিহেন্সিভ তদারকি টিম গঠন করা হয়েছে। ৩১ বছর এবার কাঁচা ও ওয়েট-ব্লু (প্রক্রিয়াকরণের প্রথম ধাপ) চামড়া রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। কেস-টু-কেস ভিত্তিতে উল্লিখিত চামড়া রপ্তানির আবেদন পর্যালোচনা ও সুপারিশ প্রদানের লক্ষ্যে ১২ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করেছে। পাশাপাশি চামড়া সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন সংক্রান্ত উদ্ভূত সমস্যা সমাধানর লক্ষ্যে কন্ট্রোল সেলও খুলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ সময়: ২১১১ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২০  
জিসিজি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।