ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

অদৃশ্য সিন্ডিকেটে অস্থির রাজশাহীর চালের বাজার

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০২০
অদৃশ্য সিন্ডিকেটে অস্থির রাজশাহীর চালের বাজার

রাজশাহী: অদৃশ্য সিন্ডিকেটে রাজশাহীতে হঠাৎ করেই অস্থির চালের বাজার। সরাসরি পাইকারি ও খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়ছে।

গত দুই সপ্তাহে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে প্রতি বস্তা চালের দাম। ফলে সাধারণ মানুষের উঠেছে নাভিশ্বাস।  

স্থানীয় পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, রাজশাহী অঞ্চলে চালের বাজার অদৃশ্য এক সিন্ডিকেটে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এ সিন্ডিকেটে অটো রাইস মিল মালিক ও শতাধিক ব্যবসায়ী রয়েছেন।  

ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যার ধোঁয়া তুলে চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে তারা। এভাবে তারা নিজেদের ইচ্ছামতো চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। বোরো মৌসুমে উৎপাদিত বেশির ভাগ ধান এসব সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা আগেই কিনে নিয়েছেন। ফলে প্রান্তিক কৃষকের হাতে এখন ধান নেই। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ধানের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর ধানের দাম বেশি হওয়ার কারণে দিনে দিনে চালের দামও বাড়ছে।

সোমবার (১২ অক্টোবর) রাজশাহীর সাহেব বাজার ঘুরে দেখা যায়, সপ্তাহখানেক আগে মানভেদে স্বর্ণা চাল ৫০ কেজির প্রতি বস্তা বিক্রি হয়েছে ২২-২৩শ টাকায়। কিন্তু বর্তমানে বস্তা প্রতি ২শ টাকা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৪শ থেকে ৪৫০ টাকা।  

এছাড়া কাটারিভোগ (সিদ্ধ) ৩ হাজার ৮শ থেকে ৪ হাজার টাকায় ও কালিজিরা চাল ৪ হাজার ৫শ থেকে ৫ হাজার টাকা, আঠাশ চাল ২ হাজার ৩শ থেকে ২ হাজার ৫শ টাকায়, মিনিকেট ২ হাজার ৬শ থেকে ৭৫০ টাকায়, বাসমতি ২ হাজার ৯শ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

খুচরা বাজারেও সব ধরনের চালের দাম বাড়তি। গত সপ্তাহে আঠাশ চাল কেজি প্রতি ৪৮ টাকা থাকলেও এখন দাম হয়েছে ৫০ টাকা। মিনিকেটের দাম কেজি প্রতি ৩ টাকা করে বেড়ে হয়েছে ৫৩ টাকা। বাসমতির দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ৫ টাকা করে। বাসমতি এখন ৬০ টাকা কেজিতে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। জিরাশালের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ২ টাকা করে। এই চাল এখন ৫২ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, সিন্ডিকেটের কারসাজিতে আড়তে ধানের দাম বাড়ায় চালের দাম বেড়েছে। বাজারে প্রতি মন আটাশ ধান ১ হাজার ৩শ টাকা, জিরা ধান ১ হাজার ৩শ ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ধানের দাম বাড়লে চালের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।  

চলতি মৌসুমে সিন্ডিকেটের কারণে বোরো ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি সরকার। বোরো সংগ্রহ মৌসুমে সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ধান কিনে নেয় তারা। লাখ লাখ মণ ধান মজুদ করে বাজার নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসে এই সিন্ডিকেট।

খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর সরকারি গুদামের জন্য বোরো ধান সংগ্রহের নির্ধারিত সময় ছিল ১৫ আগস্ট। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয় খাদ্য অধিদপ্তর। গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত রাজশাহী অঞ্চলে সরকারি বোরো সংগ্রহ হয়েছিল লক্ষ্যমাত্রার এক-তৃতীয়াংশের কম।

রাজশাহীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী বিভাগে মোট আবাদযোগ্য কৃষিজমির পরিমাণ ১৪ লাখ ১৮ হাজার ৩৯০ হেক্টর। প্রতি বছর চালের চাহিদা ২৯ লাখ ২৬ হাজার ৬০০ টন। চলতি মৌসুমে চাহিদার বেশি খাদ্যপণ্য উৎপাদন হয়েছে।  

খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের শিথিল নীতি ও তড়িৎ ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে জনগণকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। মজুদদারদের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে তারা চালের বাজার আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে।  

রাজশাহীর সাহেব বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী রওশন আলী বলেন, চালের দাম বাড়লে যাদের লাখ লাখ টন ধান-চাল মজুদ করার ক্ষমতা আছে তাদের লাভ। মৌসুমের শুরু থেকেই ধানের দাম বেশি। অটো রাইস মিল মালিকরা অনেক বেশি ধান সংগ্রহ করে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। নিয়মিত বাজার মনিটরিং না থাকায় এই চক্রটি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

আরেক ব্যবসায়ী রহমত উল্লাহ বলেন, বাজারে চালের সরবরাহে ঘাটতি নেই। সরবরাহ বেশি, কিন্তু দামও বেশি। মৌসুমের শুরুতেই মজুদদাররা ধান-চাল মজুদ করে রাখে। তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এসব সিন্ডিকেট ও মজুদদাররা সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে দেয়। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার প্রায় ২০০ অটো রাইস মিল মালিক ও শতাধিক মজুদ ব্যবসায়ী বাজার রেখেছে নিজের দখলে।

তবে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ধান কেনার কথা স্বীকার করলেও বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ অস্বীকার করছেন মিল মালিক ও মজুতদাররা।

রাজশাহী জেলা চালকল মালিক সমিতির সদস্য আব্দুল কাইয়ুম বলেন, অটো রাইস মিল মালিকরা ধানের মজুদ গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। সারাদেশে কয়েক হাজার চালকল আছে। আমরা ইচ্ছা করলেই তো আর দাম বাড়াতে পারি না। সরকার ২৬ টাকা দরে ধানের দাম বেঁধে দেওয়ায় কৃষকরা কম দামে সরকারি গুদামে ধান দেয়নি। শুরু থেকেই ধানের বাজার বেশি। তাই কৃষকের কাছে থেকে তারা বেশি দামেই কিনেছেন। আছে বেশি দামে ধান কিনে কম দামে বিক্রি করা তো সম্ভব নয়।  

আব্দুল কাইয়ুম আরও বলেন, তারা ব্যবসা করেন সরকারের বেঁধে দেওয়া নীতিমালা অনুযায়ী। কোথাও বেশি ধান-চাল মজুদ করা থাকলে সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হোক এটা তারাও চান।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০২০
এসএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।