ঢাকা, শনিবার, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

৫ বছর ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না ইচ্ছাকৃত খেলাপি

শাহেদ ইরশাদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১
৫ বছর ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না ইচ্ছাকৃত খেলাপি

ঢাকা: ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা ঋণ পরিশোধের দিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। যেতে পারবেন না বিদেশে।

বন্ধ থাকবে নিজেদের নামে বাড়ি-গাড়ি কেনার নিবন্ধন। এসব শর্ত জুড়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রণালয় ব্যাংক কোম্পানি আইনের একটি সংশোধিত খসড়া তৈরি করেছে।

সংশোধিত খসড়া অনুসারে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের চিরদিনের জন্য বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হবে না। তাদের নামে বাড়ি, গাড়ি ও কোম্পানির নিবন্ধন বন্ধ হয়ে যাবে। দাওয়াত পাবেন না রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে। কোনো কোম্পানির পদে থাকার অনুমতিও দেওয়া হবে না।

এর আগে ফিন্যান্স কোম্পানি আইনের সংশোধিত খসড়ায় ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানানো হয়। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ফিন্যান্স কোম্পানি আইনে পরিচালিত হয়।  

অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের কিছু ধারা আরও কঠোর করার পরামর্শ দিলেও বিভিন্ন সংস্থার মতামত ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কিছু ধারা সহজ করা হয়েছে।  

আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে।   

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকতে হবে। খেলাপি ঋণ পুরোপুরি পরিশোধ না করলে তার নাম খেলাপির তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পাঁচ বছর পরও কাউকে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হওয়ার অনুমতি না দেওয়া ঠিক হবে না।

তিনি আরও বলেন, কেউ ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারেন। ঋণ পরিশোধের কিছুদিন পর আবার পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হলো এবং তিনি আরও খেলাপি হতে পারেন। সুতরাং, খেলাপি ঋণ পুরোপুরি পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে পরিচালক হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত।

ড. সালেহউদ্দিন আরও বলেন, সংশোধিত আইনে এমন একটি ধারা যুক্ত করা উচিত যাতে ব্যাংকগুলো পরিচালকদের খেলাপি ঋণ সর্ম্পকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করতে বাধ্য হবে এবং খেলাপি ঘোষণা করবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে পদক্ষেপ নেবে।

‘আমি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলাম তখন ঋণ খেলাপি হওয়ায় ২-৩টি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালককে অপসারণ করেছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে খেলাপি পরিচালকদের তথ্য পেতে পারে।

সংশোধিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের একটি তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। পরবর্তীসময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কমিটি তা চূড়ান্ত করার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করা যাবে। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

তবে বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৭ ধারায় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি সংশোধিত খসড়ায়। পরিবর্তন না আনার ফলে আগের মতোই ব্যাংকের পরিচালক বা ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করা সম্ভব হবে না। যা ব্যাংক পরিচালকদের খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য বাধা।

১৭ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করলে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে নোটিশ দেবে। দুই মাসের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করতে ব্যর্থ হলে ওই পরিচালক খেলাপি ঘোষণা করা হবে।

বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকরা একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশ করে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করলেও ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে নোটিশও দেয় না। ১৭ ধারায় একটি উপধারা যুক্ত করে বলা হয়েছে, নোটিশের কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থায় একজন পরিচালক তার পদ থেকে পদত্যাগ করতে পারবেন না।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৭ ধারা সংশোধনের দাবি করেছেন। ২০১৮ সালে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে একটি বৈঠকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম বলেছিলেন, কোনো ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।

তিনি আরও বলেন, পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৭ ধারাটি বাস্তবসম্মত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক নোটিশ জারির মাধ্যমে পরিচালকদের পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারে বলা হলেও তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিতে (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাম শনাক্ত করার ব্যবস্থা থাকা উচিত।

বর্তমানে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের চারজন সদস্য থাকতে পারছেন। পরিবারের সংজ্ঞা ছোট হওয়ায় একই পরিবার থেকে একাধিক পরিচালক হতে পারছেন।

প্রথম খসড়ায় পরিবার বলতে স্বামী, স্ত্রী, বাবা, মা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন ও অন্য নির্ভরশীল সদস্যদের বোঝানো হয়েছে। প্রাথমিক খসড়ায় পুত্রবধূ, মেয়ের জামাই, শ্বশুর, শাশুড়ি এবং অন্য নির্ভরশীলদের বোঝানো হলেও সংশোধিত খসড়ায় এটি উল্লেখ করা হয়নি।

অবশ্যই ফিন্যান্স কোম্পানি আইনের সংশোধিত খসড়ায় পরিবারের সদস্য বলতে স্বামী, স্ত্রী, বাবা, মা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন, পুত্রবধূ, মেয়ের জামাই, শ্বশুর, শাশুড়ি ও অন্য নির্ভরশীলদের বোঝানো হয়েছে।

ব্যাংক পরিচালকদের খেলাপি করার অক্ষমতায় বিদ্যমান আইনেও রয়ে গেছে। প্রথম খসড়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য ব্যাংকের শীর্ষস্তরের দুই কর্মকর্তা বা মহাব্যবস্থাপকদের ঊর্ধ্বে কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া হলেও সংশোধিত খসড়া থেকে তা বাদ দেওয়া হয়েছে।  

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইনে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন হলেও খুবই যৌক্তিক। তবে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করতে হবে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে। কারণ অনেক ইচ্ছাকৃত খেলাপি রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে তালিকার বাইরে থাকার চেষ্টা করবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১
এসই/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।