স্বার্থান্বেষী মহলের অসাধু কর্মকাণ্ড, বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহার, অবৈধভাবে আমদানি ও বাজারজাতকরণে দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ কাগজশিল্প এখন বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এ তথ্য দিয়ে বিপিএমএ বলছে, চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকিতে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে কাগজশিল্প।
২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট সামনে রেখে দেওয়া প্রস্তাবে এসব কথা বলেছেন কাগজশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিপিএমএর সভাপতি আহমেদ আকবর সোবহান। ১৩ মার্চ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে দেওয়া বাজেট প্রস্তাবে বিপিএমএ বলেছে, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে কাগজশিল্প। দেশে ছোটবড় মিলে ১০৬টি কাগজ উৎপাদনকারী শিল্প প্রকল্প রয়েছে। এর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৬ লাখ টন; যা স্থানীয় চাহিদার তুলনায় ২ দশমিক ৫০ গুণ বেশি। এক দশক আগেও যেখানে আমদানির মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করা হতো, সেখানে বর্তমানে সব ধরনের কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য উৎপাদনে দেশ সক্ষমতা অর্জন করেছে। দেশের কাগজ মিলসমূহ সকল প্রকার কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্যের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করছে। কাগজ উৎপাদন বাংলাদেশে বর্তমানে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্প খাত।
এনবিআরের সাবেক চেয়াম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদের মতে, তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য বিনাশুল্কে আমদানি হওয়া কাগজজাতীয় পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করে এরই মধ্যে হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম করা হয়েছে। এর সঙ্গে বিনাশুল্কে পাঠ্যপুস্তকের জন্য ব্যবহৃত কাগজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হলে আর্থিক ক্ষতি আরও বাড়বে। দেশি কাগজশিল্প লোকসানে শেষ হয়ে যাবে।
জানা গেছে, বিগত দিনে পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহারের জন্য দেশি মিলগুলো গুণগত মানসম্পন্ন কাগজ সরবরাহ করে এসেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কাগজশিল্প আমদানি-বিকল্প, রপ্তানিমুখী ও পরিবেশবান্ধব শিল্প খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। প্রতি বছর দরপত্রের মাধ্যমে এনসিটিবি ৮০ হাজার টন কাগজ ও ৪০ কোটি মুদ্রিত বই কিনে থাকে। বিপিএমএ সদস্যরা ২০ বছর ধরে এনসিটিবির চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন কাগজ সঠিক মূল্যে যথাসময়ে সরবরাহ করে আসছে।
এ প্রসঙ্গে বিপিএমএর বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বন্ড সুবিধায় আমদানি হওয়া কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। সরকার প্রতি বছর বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহারের জন্য বিনাশুল্কে কাগজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও, একইভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করা হতে পারে। এতে রাজস্ব ক্ষতি আরও বাড়বে। কাগজশিল্প অসম প্রতিযোগিতায় ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাবে।
বিপিএমএ ওই বাজেট প্রস্তাবে আরও বলেছে, শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ ছাড়াও দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাগজশিল্প খাত অবদান রাখছে। কাগজশিল্প খাতে প্রত্যক্ষভাবে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পরোক্ষভাবে ৬০ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভর করছে। প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে। দেশের ৩০০ উপশিল্পের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুদ্রণ, প্রকাশনা, কালি প্রস্তুত, ডেকোরেশন, প্যাকেজিং ও বাঁধাই শিল্প খাত। আমদানি-বিকল্প শিল্প হিসেবে এ খাত বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করছে। কাগজশিল্প প্রকল্পগুলো রি-সাইকেলিং পদ্ধতিতে বাতিল কাগজ ব্যবহার করে কাগজ উৎপাদন করে। ফলে দেশের মূল্যবান বনজ সম্পদ রক্ষা পাচ্ছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকছে। বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়, বিপুল সম্ভাবনাময় দেশি কাগজশিল্পের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে আসন্ন বাজেটে চারটি প্রস্তাব অন্তর্ভুক্তিকরণের অনুরোধ করেছে বিপিএমএ। এক. বন্ড সুবিধায় আমদানি হওয়া কাঁচামাল হিসেবে কাপ স্টোক পেপার, ওজিআর পেপার, স্ট্রিকার পেপার, আর্ট পেপার কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, কোটেড পেপার, লাইনার পেপার, মিডিয়াম পেপার, প্যাকিং পেপারের আমদানি শুল্ক-কর ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করতে বলেছে বিপিএমএ। সংগঠনটি এ প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছে, বন্ড সুবিধায় বিনাশুল্কে আমদানি হওয়া কাগজ খোলাবাজারে বিক্রি বন্ধে এনবিআর বিভিন্ন সময় ব্যবস্থা নিলেও অবৈধ কার্যকলাপ বন্ধ হয়নি। ফলে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। বিপুল সম্ভাবনাময় কাগজশিল্প রক্ষায় বন্ড সুবিধার কাগজ আমদানি বন্ধ করা প্রয়োজন।
দুই. দেশে ৪০ জিএসএমের ওপরে সকল প্রকার লেখা ও ছাপার কাগজ আমদানিতে বর্তমান শুল্ক-কর কাঠামো বহাল রাখতে বলেছে বিপিএমএ। সংগঠনটি বলেছে, বিনাশুল্কে কাগজ আমদানির সুযোগ দেওয়া হলে স্থানীয় ও আমদানি হওয়া কাগজের মধ্যে তীব্র বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাগজ আমদানি করে খোলাবাজরে বিক্রি করা হলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। তাই কাগজ আমদানির বিদ্যমান শুল্ক ও কর কাঠামো বহাল রাখা প্রয়োজন।
তিন. থারমাল কোটিং স্লারি, থারমাল পেপার উৎপাদনের প্রধান কেমিক্যালস হওয়ায় আমদানি পর্যায়ে সিডি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে বিপিএমএ। সংগঠনটি বলেছে, দেশি কাগজ মিলসমূহে বর্তমানে আমদানি-বিকল্প পণ্য থারমাল পেপার উৎপাদন হচ্ছে, যা দীর্ঘদিন যাবৎ আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটানো হতো। বাজারে থারমাল পেপারের প্রচুর চাহিদা থাকায় এবং সরকারের উদার শিল্পনীতির সুযোগে এসব পণ্য প্রচুর পরিমাণে আমদানি হচ্ছে এবং বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হচ্ছে। আমদানি হওয়া থারমাল পেপারের চেয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মানও ভালো। এ ছাড়া এ উন্নতমানের কাগজ তৈরি হওয়ায় আমদানিনির্ভরতা কমছে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে।
চার. পেপার কাপ, প্লেট ও বোল দেশেই উৎপাদিত হওয়ায় আমদানি পর্যায়ে ট্যারিফ ভ্যালু প্রতি কেজি দেড় ডলার থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিয়েছে বিপিএমএ। সংগঠনটি এ প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছে, বর্তমানে আমদানি-বিকল্প পণ্য স্বাস্থ্যসম্মত ডিসপোজিবল পণ্য হিসেবে পেপার কাপ, প্লেট ও বোল উৎপাদন হচ্ছে, যা দীর্ঘদিন যাবৎ আমদানি করে চাহিদা মেটানো হতো। বর্তমান বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারী অবস্থায় দেশের বাজারে পেপার কাপ, প্লেট ও বোলের প্রচুর চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব পণ্য প্রচুর আমদানি হচ্ছে। ফলে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়ও হচ্ছে। অথচ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মানও ভালো। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০২১
নিউজ ডেস্ক