ঢাকা: দেশের বাজারে চালের দাম না কমার পেছনে বেশকিছু কারণ কাজ করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য তারা সরকারের অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করছেন।
তারা বলছেন, বাজারে চালের সরবরাহ কমে যাওয়া, সরকারের নীতিগত ভুল, মজুদ কমে যাওয়া, নিম্নমানের চাল আমদানি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যের কারণেই চালের দাম আগামী দেড় দুই মাসে কমবে না।
তাদের মতে, চাহিদা ও যোগানের সঠিক হিসাব করা দরকার। এজন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও তথ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে। দেশে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে দ্রুত আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে চাল আমদানিতে দ্রুত ব্যক্তিখাত খুলে দিতে হবে।
এদিকে আমদানিকৃত চাল বাজারে আসায় চালের দাম আর ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে না, আগের বাড়তি দামেই তা স্থিতিশীল। চালের দাম বাড়ায় অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল সংগ্রহ কার্যক্রম প্রায় ব্যর্থ হয়ে যাওয়া, একইসঙ্গে বিদেশ থেকে নিম্নমানের চাল আমদানি ও ধীর গতিতে আসায় সরকারের মজুদ পরিস্থিতিও খারাপ রয়েছে। ফলে চালের দাম নিয়ে দুর্ভোগে রয়েছে সাধারণ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে চাল আমদানির শুল্ক ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে সরকার। তবে চালের বাজার নিয়ে অনেকটা কৌশলী অবস্থানে সরকার। শুল্ক উঠিয়ে আমদানির গতি বাড়িয়ে চালের দাম একেবারে নামিয়েও ফেলতে চায় না সরকার, কারণ এতে আবার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সবচেয়ে বড় ধানের মৌসুম বোরোকে সামনে রেখে বুঝে-শুনে পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মুনসুর বাংলানিউজকে বলেন, বাজারে চালের সরবরাহ কমে গেছে তাই দাম বেড়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে মাত্র ১৪ থেকে ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অথচ আমাদের ঘাটতি রয়েছে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন। সরকারের মজুদও কমে গেছে। সেটাই এখন আমাদের ভোগাচ্ছে। সে ঘাটতি মিটাতে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। আর চাল আমদানির সিদ্ধান্ত আরো আগেই নেওয়া উচিৎ ছিলো। সরকার গড়িমশি করতে করতে চালের দাম বেড়ে গেছে। এজন্য সরকারের অব্যবস্থাপনাই দায়ী।
তিনি বলেন, চালের বাজারে সিন্ডকেট কাজ করে। ইচ্ছা করে তারা সময় মতো চাল আমদানি করেনি। আমরা গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বলেছিলাম, এবার চালের উৎপাদন কম হবে। কারণ বন্যা হয়েছে। এ বছর দীর্ঘদিন বন্যা হয়েছে। এরপর আমরা নভেম্বর মাসেও বলেছি, দ্রুত চাল আমদানি করা উচিৎ। কিন্তু সরকার সে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছে। সরকার জানুয়ারি মাসে এসে চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। এতো দেরিতো করার কোনো দরকার ছিলো না। আর আমাদের যেহেতু ঘাটতি আছে। কাজেই যারা চাল আমদানি করতে চায়, তারা আনুক না। এতে অনুমোদন দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। কৃষকের ক্ষতি হবে সেটা বলবেন। বর্তমানে ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা মণ ধানের দাম। সেখানে কৃষকরা ৮০০ টাকা পেলেই খুশি হয়ে যায়। আমি বলবো, সরকারের পলিসিগত ভুলের কারণেই চালের দামের এই উচ্চ অবস্থা।
আহসান এইচ মুনসুর বলেন, আর এক দেড় মাস পরেই বোরো ধান উঠবে। তখন চালের দাম কমে যাবে। মোটামুটি জৈষ্ঠ্য মাসের প্রথম সপ্তাহেই চালের দাম কমে যাবে। এবার আমাদের বোরোর আবাদ ভালো হয়েছে। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে উৎপাদন ভালো হবে। তবে সরকারকে ভবিষ্যতের বাস্তবতার নিরিক্ষে পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ আমরা খাদ্যে প্রান্তিক স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে ঘাটতি হয়ে যায়। এজন্য দক্ষ ম্যানেজমেন্ট ও তথ্যভিত্তিক মনিটরিং বৃদ্ধি করতে হবে। আমদানির জন্য ব্যক্তিখাত খুলে দিলে ভালো হয়। এর মাধ্যমে আগাম ঘাটতিটাকে মিটিয়ে দিতে পারলে কোনো সমস্যা হবে না।
খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বাংলানিউজকে বলেন, চাল আমদানির পরও দেশের বাজারে চালের দাম না কমার প্রথম কারণ হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের উচ্চমূল্য। দ্বিতীয় কারণ হলো, চাহিদার তুলনায় যোগানের পার্থক্য রয়েছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই গ্যাপের কারণে হয়তো হতে পারে। এছাড়া করোনার সময় অনেক প্রবাসী বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন। আপনারা জানেন, রোহিঙ্গাদের জন্যও খাবারের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। ফলে আমাদের চাহিদা বেড়ে গেছে। এছাড়া মৎস্য, ডেইরি ও পোল্ট্রি ফিডে চালের অংশ ব্যবহার বেড়েছে।
তিনি বলেন, আমি মনে করি চাহিদা ও যোগান এই দুইটাকে সঠিক হিসাব করা দরকার। তাহলে আমরা বুঝতে পারতাম কেন দাম কমছে না। আর একটা বিষয় হচ্ছে চালের দাম গত তিন বছরের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। কারণ ২০১৭ -১৮ সালে হাওড়ে বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছিলো, তার তিন গুণের বেশি আমদানি হয়েছিলো। যে কারণে আমাদের চাল উদ্বৃত্ত ছিলো ও বিদেশে রপ্তানির চিন্তাভাবনা করা হয়েছিলো। কিন্তু সেটাতো বাংলাদেশের উৎপাদন ছিলো না। সে সময় প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে, যা বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের সাথে যোগ হয়েছিলো। এজন্য আমাদের সারপ্লাস ছিলো। আশা করছি এ বছর আমাদের প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হবে।
বেসরকারিভাবে আমদানিকৃত চালের মান খারাপ, এজন্য দেশি চালের চাহিদা বেশি কি না জানতে চাইলে খাদ্যসচিব বলেন, আমি নিজে ঘাটে গিয়ে যেটা দেখেছি, সেটার মান অনেক ভালো। তবে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত আমদানিকৃত চালের মান নিয়ে কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ এলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।
বাবুবাজার ও বাদামতলী চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে চালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। এখন যদি চাল আমদানি না করা হতো তাহলে চালের দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা থাকতো। আমাদের দেশে বর্তমানে ধান ও চালের ঘাটতি রয়েছে। ভারত থেকে চাল আমদানি করায় চালের দাম স্থিতিশীল আছে। সামনে নতুন বোরো উঠবে তখন দাম কমে যাবে। যদি প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হয় তাহলে রমজানে আমাদের চালের দাম আর বৃদ্ধি পাবে না বরং কমে যাবে।
চালের বাজার এখন সর্বোচ্চ, তাই মিলারদের এখন মজুদ রাখার কোনো সুযোগ নেই। আশা করছি রমজানের মধ্যেই চালের দাম দুই থেকে তিন টাকা কমে যাবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি খাদ্যশস্যের সর্বশেষ (২৪ মার্চ) মজুত রয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল ৪ লাখ ৫৬ হাজার টন, আর গম ৭৭ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে এই মজুত ছিল ছিল ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ টন। এরমধ্যে চাল ১৪ লাখ ১৯ হাজার ৯০০ টন, গম ছিল তিন লাখ ১৯ হাজার ৬০০ টন।
এছাড়া এবার আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সাড়ে আট লাখ টন ধান-চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। ২৬ টাকা কেজি দরে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে দুই লাখ মেট্রিক টন ধান এবং ৩৭ টাকা কেজি দরে ছয় লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৬ টাকা কেজি দরে ৫০ হাজার টন আতপ চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
শনিবার (২৭ মার্চ ) রাজধানীর পাইকারী ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে জাত ও মানভেদে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ টাকায়, নাজিরশাইল প্রতিকেজি ৬২ থেকে ৬৫ টাকা, বাসমতি প্রতিকেজি ৬৮ থেকে ৭০ টাকা, মাঝারিমানের ২৮ নম্বর চাল প্রতি কেজি ৪৮ থেকে ৫২ টাকা, মোটা স্বর্ণা ও ইরি চাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
সরকারি বাণিজ্য সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদর অনুযায়ী, কেজিপ্রতি মোটা চালের দাম আগের মতোই ৪৬ থেকে ৫০ টাকা। সরু চালের দাম ৬০ থেকে ৬৬ টাকা।
সূত্রাপুর বাজারে আদনান রাইসের শালিক মো. ফারুক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মিল গেইটে দাম বেশি তাই দাম বাড়ছে। মিল মালিকদের জিজ্ঞেস করলে তারা কিছু বলেন না। তারা বলেন, এই দামে নিলে নেন না হলে চলে যান। তাই আমরা বেশি দামে কিনি বেশি দামে বিক্রি করি। আর ভারত থেকে যে চাল আমদানি করা হয়েছে সেটার মান ভালো না, ক্রেতারা ফেরত দিচ্ছে। তাই বাজারে চালের সরবরাহের একটা সংকট রয়েই গেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ ডিসেম্বর বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য বৈধ আমদানিকারকদের প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্রসহ ১০ জানুয়ারির মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে বলা হয়। এরপর প্রথম ধাপে বিভিন্ন শর্তে বেসরকারি পর্যায়ে সর্বমোট ৩২০ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ ২০ হাজার টনের মতো সিদ্ধ চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগ চাল এখনও বাজারে আসেনি। এর মাধ্যমে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যারা ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট-এলসি) খুলতে পারেনি, তাদের বরাদ্দপত্র বাতিল করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। আর বাকিদের বরাদ্দের চাল আমদানি করে বাজারজাত করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২১
জিসিজি/এজে