ঢাকা: আর কয়েকদিন পরেই বাংলা নববর্ষ ও পরিত্র রমজান মাস শুরু। এ দুই উৎসবকে ঘিরে প্রতি বছরই চলে রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্য।
ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর পথে বাধা করোনাভাইরাস। এই পরিস্থিতিতে সরকারকে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যাতে কমে সেজন্য যে মাত্রায় স্বাস্থ্যবিধি মানা দরকার সে মাত্রায় স্বাস্থ্যবিধি মানাতে জনগণ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে অর্থদণ্ড ও প্রতিষ্ঠান বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে অর্থনীতির স্বার্থেই সীমিত পরিসরে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও সাপ্লাই চেইন সচল রাখতে হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে সিপিডির সিনিয়র গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য উৎসবকেন্দ্রিক। এর মধ্যে বৈশাখ, রমজান ও ঈদ হলো অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে এ বছরের প্রেক্ষাপট গত বছরের চেয়ে ভিন্ন। গত বছর করোনা সবার কাছে অপরিচিত একটি রোগ ছিলো। মানুষের অজানা একটা আশঙ্কা ছিলো, পাশাপাশি অর্থনীতির ঝুঁকি ছিলো। মানুষের মধ্যে যে সীমিত সামর্থ্য ছিলো সেগুলো দিয়ে মানুষ টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ বছর যেটা হয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেক্ষাপটে নতুন করে কাজ কমে যাচ্ছে। ফলে যেটা হয়েছে মানুষের হাতে সঞ্চয় নেই, সীমিত আয়ের সুযোগ নেই। এখনও অনেকেই কাজে ফিরতে পারেনি, নতুনদের তো সুযোগ নেই। এই প্রেক্ষাপটে গত বছর মানুষ নিজস্ব শক্তি দিয়ে যতোটা দাঁড়ানোর সুযোগ ছিলো। এ বছর কিন্তু সেই সুযোগটা আরও সীমিত হয়ে গেছে। তাই এ বছর উচিত হবে সীমিত পরিসরে কাজের সুযোগ অব্যাহত রাখা।
তিনি বলেন, তবে একটা বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে সেটা হলো কোভিডে আক্রান্ত ও মৃত্যু যাতে কমে সেটা নিশ্চত করে যতটুকু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ দেওয়া যায়। তার জন্য যে মাত্রায় স্বাস্থ্যবিধি মানা দরকার সে মাত্রায় স্বাস্থ্যবিধি মানাতে জনগণ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করা। এ ক্ষেত্রে সারা দেশের মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে আরও সচল করতে হবে।
সরকারের নতুন করে প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার যদি দীর্ঘকালের জন্য লকডাউনে না যায় আর সীমিত পরিসরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকে তাহলে ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু প্রয়োজন হবে সাধারণ মানুষ, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য। ইত্যোমধ্যে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। তাই ট্রাক সেল, ভিজিবিএফ কার্যক্রম অব্যাহত রাখাসহ আরও বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে সরকার যদি এককালীন কিছু অর্থ সাহায্য করতে পারে তাহলে সেটাও বিবেচনায় করতে পারে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, করোনাভাইরাস গত বছরের মতো এবারও বৈশাখ ও ঈদ কেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। অনেক ব্যবসায়ী এবার পথে বসে যাবে। পরপর দুই বছরের ধাক্কায় ব্যবসায়ীদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। তাই এ অপূরণীয় ক্ষতি কীভাবে সামলে উঠবেন সে চিন্তাতেই দিশেহারা ব্যবসায়ীরা। কত টাকার ক্ষতি হয়েছে তার হিসাব করা কঠিন। কারণ এর প্রভাব আরও কতদিন থাকে তা বলা যাচ্ছে না। প্রাথমিক ধারণা আমাদের একদিন দোকান পাট বন্ধ থাকলে ৫৬ লাখ ব্যবসায়ীর ক্ষতি প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এজন্য আমরা সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দিনে ৪ ঘণ্টার জন্য দোকান খোলার অনুরোধ জানালে সরকার তাতে সম্মতি দেন ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত। এতে করে আমাদের কিছু উপকার হয়েছে। কিন্তু ১৪ এপ্রিল থেকে আবার কঠোর বিধিনিষেধ আসছে। আমরা সরকারারের কাছে প্রার্থনা করবো দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এখনকার মতো তখনও যেন সীমিত পরিসরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দোকানপাট খোলার অনুমতি দেয়। তা না হলে ব্যবসায়ীরা মারা যাবে!
ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সাবজাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, করোনায় গত বছর আমাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমরা আমাদের জমানো পুঁজি ভেঙে খাচ্ছি। এ বছরও লকডাউনে আছি। যদিও সরকার ৫ দিনের একটা সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রেখে সুযোগ দিলে তো লাভ হবে না। আমরা পাইকারি ব্যবসা করি, সারা দেশে আমাদের পণ্য যায়। এরকম বিধিনিষেধের জন্য আমাদের বেচাকেনা প্রায় বন্ধ। এখন আমাদের কর্মাচারী নিয়ে মাঠে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
সারা ফ্যাশন হাউসের সহকারী ব্যবস্থাপক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা রাহাত বাংলানিউজকে বলেন, গত বছরের এই সময় আমাদের সাধারণ ছুটির মধ্যে কাটাতে হয়েছে। এ বছর বৈশাখ ও ঈদের বেচাকেনা একসাথে হবে। করোনার জন্য সবার মধ্যেই একটা আশঙ্কা কাজ করছে। তারপরও আমরা বিনিয়োগ করেছি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। এ বছরও বিধিনিষেধের মধ্যে আছি। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের শো-রুমগুলো খোলা রাখছি আগামী ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত। তারপর শোনা যাচ্ছে সরকার সবকিছু বন্ধ করে দেবে। আমরা এ বছর আশা নিয়ে বিনিয়োগ করেছিলাম। এখন সেটা হচ্ছে না। এই যে দুই বছরে ব্যবসায়িক ক্ষতি তা পূরণ করতে কতদিন সময় লাগবে জানি না। আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে আশার আলো খুঁজছি।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বৈশাখের বাজারে দেশীয় বাঁশ, বেত, কাঠের তৈরি জিনিস, মাটির তৈজসপত্র, খেলনা, প্লাস্টিকের খেলনা, বিভিন্ন ধরনের মুড়ি-মুরকি, নাড়ু বাজারেই বিকিকিনি হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। এর বাইরে আরও প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার অন্য পোশাক বিক্রি হয় বৈশাখী বাজারে। তাছাড়া ইলিশের বেচাকেনা হয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার। একইভাবে মিষ্টির দোকানগুলোয় বৈশাখে বিক্রি হয় ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার মিষ্টি। সবমিলে বৈশাখে বিক্রি হয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য। গত বছরের ধাক্কা সামলিয়ে ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানোর পথে আবারো বাধা হলো করোনা। এর সঙ্গে রমজান ও ঈদকে ঘিরে ব্যবসায়ীদের লেনদেন হয় প্রায় লাখ কোটি টাকার মতো।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২১
জিসিজি/এমজেএফ