ঢাকা: সবুজ শিল্পবিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে। দুটি ব্লকে প্রায় এক হাজার একর জায়গাজুড়ে পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা (গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি) গড়ে তোলার মাধ্যমে এই বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা)।
‘ডেভলপমেন্ট অব ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’ প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে যাচ্ছে দেশের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ। এ প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ বেড়েছে ১৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা।
মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে এমন তথ্য জানা গেছে।
ইআরডি সূত্র জানায়, দ্বিতীয় এলওসির আওতায় ভারত মোট ৯০ মিলিয়ন বা ৭৭৪ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিল। এখন প্রকল্পের আওতায় আরও ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ বাড়িয়ে দিচ্ছে দেশটি।
সূত্র আরও জানায়, দ্বিতীয় এলওসির আওতায় মোংলা ও ভেড়ামারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে ভারতীয় ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে ভেড়ামারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে সম্মতি দেয়নি ভারত। শুধু মোংলাতে ১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য দিয়েছি দেশটি। বাকি ৭৫ মিলিয়ন বা ৬৪৫ কোটি টাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরীতে (বিএসএমএসএন) দিতে চেয়েছে।
ফলে ৯০ মিলিয়ন ডলারের সঙ্গে এই প্রকল্পে আরও ৭৫ মিলিয়ন ডলার যোগ হবে। ফলে এই প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ বেড়ে দাঁড়াবে ১৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২ হাজার ১১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৭১০ কোটি টাকা। বাকি ১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা দেবে ভারত।
সরকারি উৎস থেকে বার্ষিক ১ শতাংশ হার সুদে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে প্রস্তাব করা হয়েছে এবং ভারতীয় নমনীয় ঋণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটি চলতি সময় থেকে ২০২৫ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় শিল্পনগরের সাব জোন ১৭-তে একটি ৫০ এমএলডি সিইটিপি, সাব জোন ১৬-তে একটি ৫০ এমএলডি ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট এবং বিভিন্ন সাব জোনে ২৭ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। ইতোমধেই প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) ইআরডি এবং ভারতীয় হাইকমিশনে পাঠানো হয়েছে।
ইআরডির এক ঊর্ধতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ভেড়ামারা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ঋণ দিতে ভারত সম্মত হয়নি। ফলে এই বাড়তি ঋণ বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীতে দেবে ভারত। ফলে প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ বেড়ে হবে ১৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অর্থনৈতিক জোন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরী (বিএসএমএসএন) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি দেশের শিল্পখাতের জন্য মডেল হিসেবে কাজ করবে। একইসঙ্গে এটিই হবে দেশের সবচেয়ে বড় ইকোনমিক জোন, যার মোট আয়তন ৩০ হাজার একর। এতে কর্মসংস্থান হবে অন্তত ১৫ লাখ মানুষের।
ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে করিডোর ও বঙ্গোপসাগর উপকূলের নিকটবর্তী স্থানে চট্টগ্রামের মীরসরাই ও সীতাকুন্ড এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় যোগাযোগ সুবিধা থাকায় অভিবাসন বা সেটেলমেন্টের প্রয়োজন না থাকায় ওিই এলাকায় সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিল্প নগরের জোন ‘২এ’ এবং জোন ‘২বি’সহ অন্যান্য জোনসমূহে অবকাঠামো উন্নয়ন ও ইউটিলিটি সুবিধা সৃষ্টি করে অত্যাধুনিক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যে মীরসরাই ও সোনাগাজী উপজেলায় প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। প্রকল্পটি তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের আওতায় প্রায় ৩০টি জোনে বিভক্ত।
শিল্পনগরের জোন-১ (মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল) এর আওতাভুক্ত ৫৪৮ একর ভূমি উন্নয়নসহ অন্যান্য জোনের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ইউটিলিটি সেবা সৃষ্টি করা হবে। জোন ২এ-তে ৯৩৯ একর ও জোন ২বি-তে ৪৭৪ একরেরও উন্নয়ন করা হবে।
শিল্পনগরে ৩০ কিলোমিটার চারলেন সড়ক, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস নেটওয়ার্ক, নিরাপত্তা বেষ্টনী, প্রশাসনিক ব্যবস্থা উন্নয়ন, ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট, স্টিম নেটওয়ার্ক, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, সোলার প্যানেল ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্থাপনের মাধ্যমে ‘গ্রিন ইকোনোমিক জোন’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
এ শিল্পনগরী ঘিরে আশপাশের এলাকাগুলোতেও গড়ে উঠছে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীর সঙ্গে যুক্ত হবে চট্টগ্রামে নির্মিতব্য বে-টার্মিনাল। এতে সহজ হবে পণ্য আমদানি-রপ্তানি। বিশেষ করে এই শিল্পনগরীতে উৎপাদিত পণ্য সরাসরি রপ্তানি হবে বে-টার্মিনাল দিয়ে। এখন পর্যন্ত এ শিল্পনগরীতে দেশের বিভিন্ন কোম্পানির পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসেবে এগিয়ে এসেছে জাপান, চীন, ভারত, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া।
জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীর সবুজ অংশে ৫০০ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত হচ্ছে বসুন্ধরা শিল্পাঞ্চল। এই শিল্পনগরীতে জমি বরাদ্দ পাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে বসুন্ধরাই সর্বপ্রথম ভারী শিল্প স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। এ লক্ষ্যে দ্রুত এগিয়ে চলেছে শিল্প-কারখানা স্থাপনের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। ইতোমধ্যে প্রশাসনিক ভবনের বেইজমেন্টের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। সম্পন্ন হয়েছে ডরমেটরি ভবনের দোতলার ছাদ। আর বসুন্ধরা কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের কাজ শুরু হবে আগামী মাসেই। সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের ডিসেম্বরে উৎপাদন শুরু হবে এই কারখানায়। বসুন্ধরা মাল্টি স্টিল মিলস নির্মাণকাজ উদ্বোধনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এটিরও ২০২১ সালের মধ্যে উৎপাদনে যাওয়ার কথা।
বসুন্ধরা প্রি-ফেবরিকেটেড কোম্পানির কারখানা নির্মাণকাজের সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে। এমনকি এ শিল্পনগরীতে বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোন নিয়মিত দাফতরিক কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে আগামী মাস থেকেই। শুধু বসুন্ধরা ইকোনমিক জোনেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
এছাড়া সবুজ শিল্পাঞ্চল অংশে এশিয়ান পেইন্ট, মডার্ন সিনটেক্সের শিল্প-কারখানার অবকাঠামোর নির্মাণযজ্ঞ চলছে দ্রুতগতিতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০২১
এমআইএস/এমজেএফ