রাজশাহী: চলতি বছর মাঘের শুরুতে শীতের তীব্রতার মধ্যে রাজশাহীতে আম গাছে মুকুল আসে। এসময় টানা ঘন কুয়াশার কারণে মুকুলের বেশ ক্ষতি হয়।
এত সব ধকল সামলে মুকুল যখন আমের গুটিতে পরিণত হলো তখন শুরু হলো তীব্র তাপদাহ। প্রায় এক মাস ধরে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি। দীর্ঘদিন দেখা নেই বৃষ্টির। ফলে কৃষকের স্বপ্নের আমে লেগেছে গ্রহণ। বর্তমানে পানি শূন্যতায় আমের বোটা লাল হয়ে ব্যাপক হারে গাছ থেকে ঝরে পড়ছে আম। এতে বাগান মালিকরা পড়েছেন চিন্তায়। অনেকে আম ঝরে পড়া রোধে বাগানে পানি ছিটাচ্ছেন। গাছের গোড়ায় দিচ্ছেন সেচ। কিন্তু তাপদাহের দাপটে তাতেও তেমন কাজ হচ্ছে না। ফলে আম চাষিদের মধ্যে এবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, রাজশাহীতে চলতি বছর ৩৭৩ হেক্টর বেড়ে ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর ১৭ হাজার ৫৭৩ হেক্টর জমিতে আম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে হেক্টর প্রতি ১১ দশমিক ৯ মেট্রিক টন। মোট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন।
আমচাষিদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, চলতি মৌসুমের শুরুতে গাছে গাছে ভরা মুকুল এসেছিল। শীতের শেষে ও গ্রীষ্মের শুরুতে ঘন কুয়াশার দাপটে মুকুলের ক্ষতি হলেও আশানুরূপ আমের গুটি আসে। অনেকে আমের বাম্পার ফলনের আশা করছিলেন। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে সে আশায় গুড়েবালি।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রায় এক মাস ধরে রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৪ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বুধবার (২৮ এপ্রিল) বিকেল ৩টায় রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) ছিল ৩৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া ২০ এপ্রিল এবং ২৫ এপ্রিল এই দু'দিনই রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি এখন পর্যন্ত চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। অথচ বৃষ্টির দেখা নেই। ভারী বৃষ্টিপাতের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে বলছে আবহাওয়া অধিদফতর।
আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবছর আমের মুকুল দেখে ভালো ফলনের আশা করেছিলেন সবাই। কিন্তু পরবর্তীসময়ে প্রকৃতি ঠিক উল্টো আচরণ শুরু করেছে। রাজশাহীতে প্রায় পাঁচ মাস ধরে বৃষ্টি নেই। ফলে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। তাপমাত্রাও বেশি। অতিরিক্ত খরার কারণে অপরিণত আম ঝরে যাচ্ছে।
রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলার আম বাগানগুলো ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ বাগানে গাছের নিচে পড়ে আছে অপরিপক্ব আম। গোপালভোগ, ল্যাংড়া, হিমসাগর, আশ্বিনাসহ ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির কাঁচা আম ঝরে যাচ্ছে। লোকসান ঠেকাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন চাষিরা। দূর থেকে পানি এনে আম ঝরে পড়ারোধে গাছে স্প্রের মাধ্যমে প্রয়োগ করছেন। কিন্তু খরাপ্রবণ বরেন্দ্র এলাকায় পানি সংকটে অনেক বাগানে সে সুযোগও মিলছে না।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর পৌর সদরের আমচাষি আব্দুর রহিমের বাগানে প্রায় ৬শ গাছ আছে। সে বাগানে এবার ভরা মুকুল এসেছিল। গত মৌসুমের ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে তাকে লোকসান গুনতে হয়েছে। এ মৌসুমে সেই লোকসান কাটিয়ে উঠবেন আশা করেছিলেন। কিন্তু মুকুলগুলো আমে পরিণত হওয়ার পর ঝরে পড়েছে সেই স্বপ্ন। বৈরী আবহাওয়ায় ব্যাপকহারে আম ঝরে যাচ্ছে।
আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে বলেন, বৈরী আবহাওয়া কখনই আমের অনুকূলে থাকছে না। গতবছর ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। এবছর তীব্র গরমে আম ধরে পড়ছে। ছত্রাক আক্রমণও বেড়েছে। গত ৪-৫ মাস বৃষ্টি নেই। বছরটা আমের জন্য ভালো যাচ্ছে না। ফলন অনেক কম হবে।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরের আমচাষি সাইদুল ইসলাম বলেন, আমার ২০ বিঘা জমিতে গোপালভোগ ও ল্যাংড়া জাতের আম গাছ রয়েছে। আমবাগান শুকিয়ে চৌচির। গাছের গোড়া শুষ্ক থাকলে আম টিকবে না। বৃষ্টি না হলে এবার ফলন বিপর্যয় ঘটবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোনোমি অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের শিক্ষক ড. মো. আলিম বলেন, মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা ও অনাবৃষ্টির কারণে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। ফলে আম ঝরে পড়ছে। এজন্য গাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি দিতে হবে। গাছের গোড়ার চারপাশে গর্ত করে সকাল-বিকালে পানি দিতে হবে। এছাড়া গাছে সার প্রয়োগ করতে হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক এলাকায় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। তাই শতভাগ বাগানে সেচ দেয়া অসম্ভব। দ্রুত সময়ে বৃষ্টি না হলে ফলন বিপর্যয় হতে পারে।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের মsখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দীন বাংলানিউজকে জানান, গতবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা আমচাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে টানা খরার কারণে কিছু গুটি ঝরছে। এজন্য সকালে আমগাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে আমে স্প্রে করতে হবে। এতে গুটি ঝরা কমবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৯ ঘণ্টা, মে ০১, ২০২১
এসএস/এএ