বগুড়া: করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে আর্থিক সংকটে পড়েছেন বগুড়ার সেমাই পল্লীখ্যাত বেজোড়া, শ্যামলা কাথিপাড়া, কালসিমাটি, রবিবাড়িয়াসহ প্রায় ১০টির বেশি গ্রামের সেমাই তৈরির কাজে যুক্ত থাকা শত শত নারী শ্রমিক ও ব্যবসায়ী।
বগুড়া সদর ও শাজাহানপুর উপজেলায় এসব গ্রামের অবস্থান।
সেমাই চিকন, রঙ সাদা, তবে স্বপ্নটা রঙিন। ঈদুল ফিতরের উৎসবকে ঘিরে চিকন সাদা সেমাইয়ে রঙিন স্বপ্নে বিভোর থাকেন এই স্বপ্নবাজরা। স্বপ্ন কতোটুকু পুরণ হবে সেটা তো পরের বিষয়। বেঁচে থাকতে স্বপ্নের কোনো বিকল্প নেই। স্বপ্ন নিয়ে সামনে এগোতে হবে খেঁটে খাওয়া মানুষদের।
প্রতি বছর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রমজান মাসে সাদা সেমাইয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে বলে এসময় এর উৎপাদনও বেড়ে যায়। কিন্তু গেল বছরের মতো এবারও করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংকটময় সময়ে সেমাই উৎপাদনে টান পড়ে। এতে হালিমা, পারুল, জাহানারা, পারভীন, নাসিমার মতো অসংখ্যক নারী শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রতিবছর এ সময়টায় পাল্লা দিয়ে কাজ করতেন সেমাইপল্লীর নারী কারিগররা। করোনার প্রভাবে স্বপ্নগুলো যেন তাদের ধরা দেয়নি।
তাদের স্বপ্নে করোনা বাগড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেই চাহিদা, সেইসঙ্গে ঘুরছেনা মেশিনও। আর তাই করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেমাই সরবরাহ করতে পারছেন না কারখানা মালিকরা। এতে সীমিত আকারে চলছে সেমাই তৈরির কাজ।
সোমবার (৩ মে) বগুড়ার সদর ও শাজাহানপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সেমাইপল্লীর কারখানার মালিক ও কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমনই তথ্য জানা যায়।
শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা ইউনিয়নে বেজোড়া গ্রামটি থেকে চিকন সাদা সেমাইয়ের জন্ম। স্বাধীনতার পর থেকেই এ গ্রামের কয়েকটি পরিবার চিকন সেমাই তৈরি শুরু করেন। তবে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানাতে পারেননি স্থানীয়রা। সময়ের ব্যবধানে এ শিল্প বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে এখানকার তৈরি চিকন সাদা সেমাইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে। সারা বছরই কমবেশি সাদা সেমাই তৈরি করা হয় গ্রামটিতে। প্রত্যেক বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহায় রেকর্ড পরিমাণ সেমাই তৈরি করেন কারখানার মালিক-শ্রমিকরা।
কিন্তু এবারে তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। রমজানের শুরু থেকেই করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারাদেশের মত বগুড়ার সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গত ১৪ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক দফায় বাড়িয়ে তা ২৮ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ রাখা হলেও ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে মানুষের জীবন-জীবিকার কথা চিন্তা করে সরকারের পক্ষ হতে সারাদেশে বেশ কয়েকটি শর্তে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দোকান-পাট ও মার্কেট খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন।
শাজাহারপুর উপজেলার নিশচিন্তপুর গ্রামের সেমাই কারখানার মালিক রফিকুল ইসলাম, জোনায়েদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, সেমাই কারখানাগুলোতে প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরের চিত্রটা ভিন্ন। করোনা ভাইরাসের কারণে সেমাই উৎপাদন তুলনা মূলক অনেক কম। প্রতিবছর যেখানে রমজানের আগে থেকে কারখানায় প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত চলতো কর্মযজ্ঞ সেখানে চলছে সীমিত পরিসরে। সারাদেশসহ বগুড়ায় লক ডাউনের কারণে রমজানের মধ্যবর্তী পেরুলেও ঘুরছেনা মেশিন, সেমাই তৈরির কাজ চলছে সীমিত আকারে।
তারা বলেন, সরকারের সিদ্ধান্তে দোকান খোলা রাখার অনুমতি দেওয়ার পরপর নারী শ্রমিকরা ছুটে আসেন কারখানাগুলোতে। রোজার অর্ধেক চলে গেছে। এখন সেমাইপল্লীর কিছু কারখানা একটু ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। করোনার আগের ঈদগুলোতে প্রত্যেক কারখানায় গড়ে প্রতিদিন প্রায় পাঁচশত কেজির মতো ময়দা থেকে সাদা সেমাই তৈরি করা হয়। যার পরিমাণ প্রায় বিশ খাঁচি। কিন্তু এবার জেলার বাহিরের মহাজনদের চাহিদা না থাকায় কোনো রকম সচল রাখা হয়েছে কারখানাগুলো।
নিশচিন্তপুর এলাকার ইয়াছিন মোল্লা বাংলানিউজকে জানান, এ এলাকার অনেক কারখারার মতো তার কারখানাতেও কাজ করতেন ১০-১২ জন নারী শ্রমিক। দেশের এ পরিস্থিতিতে সেমাইয়ের চাহিদা না থাকায় গতবারের মতো এবার কাজ করছেন পাঁচ জন শ্রমিক। করোনা মহামারীর আগের ঈদ বাজারে তার কারখানায় ৫০ কেজি ওজনের ৪০০ বস্তার মতো ময়দার সেমাই তৈরি হতো। এবছর সেখানে মাত্র ১০০ বস্তা ময়দার সেমাই তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, এবছর সেমাই কারখানা খোলার কোনো সিদ্ধান্তই ছিলো না তার। কেননা জেলার বাহিরের মহাজনরা অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখলেও চাহিদা না থাকায় তারা মাল নিচ্ছেন না। একদিকে গণপরিবহন বন্ধ অন্যদিকে পণ্যবাহী ট্রাকের ভাড়া গুণতে হচ্ছে ডাবলেরও বেশি। এ কারণে সেমাই জেলার বাহিরে বিক্রিতে সংশয় রয়েছে। তাছাড়া বগুড়ার উৎপাদিত সাদা সেমাই স্বজেলাসহ উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। করোনাকালীন তা থমকে রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সেমাইপল্লীর হালিমা, পারুল, জাহানারা, হেনা বেগম, সালেহা বেওয়াসহ একাধিকা নারী শ্রমিক (কারিগর) বাংলানিউজকে জানান, বছরের ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাতে সেমাই কারখানায় কাজের চাপ বেশি হয়। প্রত্যেক বছরের ঈদুল ফিতরের আগ মুহূর্তে বিশেষ করে রমজানের কিছুদিন আগে থেকে এ পেশার সঙ্গে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক যুক্ত হয়ে পরেন।
তারা বলেন, ঈদের সময় প্রতিটি কারখানায় সেমাই উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তবে গেল বছরের মতো এবছরও করোনা তাদের অভাবের সংসারের বাতি যেন নিভুনিভু করে দিয়েছে। একেতো অভাবের সাথে যুদ্ধ করে চলে সংসার তার মধ্যে কাজ নেই, সেমাইয়ের উৎপাদন নেই তাই পয়সাও নেই।
তারা আরও বলেন, প্রত্যেকটা কারখানায় তাদের পারিশ্রমিক আসে সেমাই তৈরির উপর। তারা নারীরা দলবদ্ধ ভাবে কারখানাগুলোতে কাজ করেন। এক বস্তা (৫০ কেজি) ময়দার সেমাই বানিয়ে তারা পারিশ্রমিক পান ১২০ টাকা। দিনে পাঁচ জনের একটি দল আট থেকে ১০ বস্তা ময়দার সেমাই তৈরি করা যায়। এতে যা পয়সা পাওয়া যায় সমান ভাবে ভাগ করে নেন তারা।
এদিকে কারখানার মালিকরা জানান, বিগত বছরগুলোতে ঈদের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রত্যেক কারখানায় গড়ে ২০০-২৫০ বস্তা ময়দার সেমাই তৈরি হতো। যার প্রতিটি বস্তায় ৫০ কেজি ময়দা থাকে। শ্রমিকরা প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ময়দা দিয়ে সেমাই তৈরি করে পারিশ্রমিক পান ১২০ টাকা।
এ চিকন সেমাই কিনতে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে ব্যাপারীরা বগুড়ায় আসেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা জেলা শহরের প্রতিনিয়ত ট্রাক যোগে সেমাই নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫০ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০২১
কেএআর