ঢাকা: কোরবানির ঈদে পশুর চামড়ার দাম নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই এক ‘আজব খেলা’ দেখছে দেশের মানুষ। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এবারও সেই পুরনো খেলাই চলবে।
কয়েক বছর ধরে অস্বাভাবিক কম দামে কোরবানির চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ। লাখ টাকা দামের গরুর চামড়াও বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। লাখ লাখ টাকার চামড়া পচে নষ্ট হওয়ার ঘটনাও আছে। বহনের খরচও না ওঠায় রাস্তার ধারে চামড়া ফেলে দিয়ে যাওয়ার ঘটনা তো প্রতিবছরই আছে।
সরকার প্রতিবছর চামড়ার দাম বেঁধে দিলেও তা কোনো কাজে আসে না। অদৃশ্য এক সিন্ডিকেটের ফাঁদে হাবুডুবু খাচ্ছে কাঁচা চামড়ার ঈদের বাজার।
বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, চামড়ার দাম নিয়ে যে আজব খেলা চলে, তার মাঠ তৈরি করেন ট্যানারি মালিক আর আড়তদাররা।
আড়তদাররা বলেন, ট্যানারি মালিকরা চামড়া নিয়ে টাকা পরিশোধ করেন না। দুতিন বছরের বকেয়া পড়ে আছে।
অন্যদিকে ট্যানারি মালিকরা বলেন, আড়তদারদের দাবি ঠিক নয়। দেউলিয়া প্রতিষ্ঠান বাদে প্রায় সবাই বকেয়া পরিশোধ করেছেন। তাছাড়া ব্যবসা করতে গেলে দেনা-পাওনা থাকবেই।
ফল যা হওয়ার তাই হয়। টাকা না থাকর অজুহাত দাঁড় করিয়ে ঈদের দিন আড়তদাররা চামড়া কিনতে চান না। ফলে চামড়ার দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়।
একটু ভাবলেই বোঝা যায়, অতি অল্প দামে চামড়া কেনার জন্য এটা ব্যবসায়ীদের এক ধরনের কৌশল। এবারও সে কৌশলের পথেই হাঁটছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। গতবারের মতো এবারও তারা করোনা মহামারিকে বাড়তি অজুহাত হিসেবে দাঁড়া করাচ্ছেন।
ট্যানারি মালিকরা বকেয়া পরিশোধ করেননি, তাই চামড়া সংগ্রহ করতে পারবেন কি না তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও লালবাগ পোস্তার কাঁচা চামড়ার আড়তদাররা চামড়া সংরক্ষণের আয়োজন নিয়ে এখন খুব ব্যস্ত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কাঁচা চামড়া সংগ্রহের জন্য আড়তগুলো ধোয়া মোছার কাজ চলছে। কেউ লবণ সংগ্রহ করছেন। কারণ কাঁচা চামড়া সংগ্রহের অন্যতম উপকরণ লবণ।
আড়তদাররা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে এবারও তারা আশঙ্কায় আছেন। ট্যানারি মালিকরা বকেয়া পরিশোধ না করলে তারা চামড়া সংগ্রহ করতে পারবেন না।
শাহাদাত লেদার আড়তের মালিক রাশিদুজ্জামান রাশেদ বাংলানিউজকে বলেন, ট্যানারি মালিকেরা চামড়া নিয়ে যায় কিন্তু টাকা দেয় না। তারা আমাদের টাকা না দিয়ে সাভারে ট্যানারির ভবন তৈরি করে। অথচ আমাদের পাওনা দেয় না। পাওনা টাকা না দিলে চামড়া সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিএইচএসএমএ) সূত্র জানিয়েছে, লালবাগ পোস্তায় মোট ১৫০টি কাঁচা চামড়া সংগ্রহের আড়ত রয়েছে। এসব আড়তে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে দেড় থেকে দুই লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এসব আড়ত থেকে ১৫০ কোটি টাকার কাঁচা চামড়া নিয়েছেন ট্যানারি মালিকেরা। কিন্তু ২০১৭ সালের পর এখনো কাঁচা চামড়া বাবদ টাকা পরিশোধ করেনি। বিধায় আসন্ন কোরবানির ঈদে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ নিয়ে বিপাকে আড়তদারেরা। প্রতিবছর দুই কোটি ২৫ লাখ পশুর চামড়া হয়। এর মধ্যে কোরবানির সময় পাওয়া যায় এক কোটি ২০ লাখ থেকে এক কোটি ২৫ লাখ চামড়া। এ বছরও করোনা সংকটের মধ্যে বেশি পশু কোরবানি হবে।
বিএইচএসএমএ সভাপতি আফতাব খান বাংলানিউজকে বলেন, ট্যানারি মালিকেরা আমাদের কাছ থেকে চামড়া নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেইভাবে টাকা পরিশোধ করে না। এখনো ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে পোস্তার আড়তদাররা ১৫০ কোটি টাকা পাবে। এসব টাকা না পেলে আসন্ন ঈদে চামড়া সংগ্রহ কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের কাছে নাটোর, রাজশাহী ও চট্টগ্রামসহ সারা দেশের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চামড়া দিয়ে গেছে। ট্যানারির মালিকেরা টাকা দিতে পারছে না বলে আমরা প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের টাকা পরিশোধ করতে পারছি না। প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের টাকা না দিলে চামড়াও পর্যাপ্ত পরিমাণে সংগ্রহ হবে না। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের বলেছি কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, লবণের দাম হঠাৎ বেড়ে যায় কি না তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন আড়তদাররা। বর্তমানে এক বস্তা লবণ (৭২ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়। চামড়ায় লবণ দেওয়ার জন্য হাজারো শ্রমিক ময়মনসিংহ ও রংপুর থেকে পোস্তায় আসেন। এসব শ্রমিক এবার আসতে না পারলে চামড়া সংরক্ষণ হুমকির মধ্যে পড়বে।
কাঁচা চামড়ার আড়তদার হাজী অ্যান্ড সন্সের মালিক মাসুম ক্বারী বলেন, কাঁচা চামড়া নিয়ে আমরা অনেক ভয়ে আছি। বাপ দাদার ব্যবসা, তাই ঈদের সময় লোভ সামলাতে পারি না। কিন্তু চামড়া কিনবো কিভাবে? ট্যানারি মালিকেরা তো আমাদের বকেয়া পরিশোধ করে না।
দেশের ট্যানারি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) জানায়, বকেয়া না পাওয়ার অভিযোগ পুরনো। ব্যবসা করতে গেলে বকেয়া থাকবেই। দুই চারটি ট্যানারি দেউলিয়া হয়ে গেছে। শুধু তাদের কাছ থেকেই পোস্তার আড়তদাররা টাকা পাবেন।
বিটিএ চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, যে সব ট্যানারির মালিকেরা দেউলিয়া হয়ে গেছেন, তারা বকেয়া পরিশোধ করতে পারেননি। এগুলো পুরনো অভিযোগ। ঈদ এলেই আড়তদাররা এসব পুরনো অভিযোগ সামনে এনে বসে থাকে।
কোরবানি ঈদের এক সপ্তাহ আগে চামড়ার দাম ঠিক করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় ঢাকার জন্য লবণযুক্ত গরুর কাঁচা চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অন্যদিকে খাসির চামড়া সারা দেশে প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা ও বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। চলতি বছরে চামড়ার দাম একই রাখার জন্য সুপারিশ করেছে বিটিএ।
গত বছরের তুলনায় এবার সারাদেশে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা বেড়েছে। গত বছর সারাদেশে কোরবানি জন্য লালন-পালনকৃত পশুর সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি। আসন্ন ঈদুল আযহা ২০২১ সালে মাঠ পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী কোরবানিযোগ্য ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার গরু-মহিষ, ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ছাগল ভেড়া, ৪ হাজার ৭৬৫টি অন্যান্য প্রজাতিসহ (উট, দুম্বা) সর্বমোট প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি গবাদি পশু প্রস্তুত আছে। কোরবানির ঈদে প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজার গরু, মহিষ ও ছাগল কোরবানি দেওয়া হবে। এর মধ্যে ১ কোটি কাঁচা চামড়া সংগ্রেহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে পোস্তার আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিএইচএসএমএ), বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) ও বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফই)।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৯, ২০২১
এমআইএস