ঢাকা: দেড় সপ্তাহ পর কোরবানির ঈদ। চলমান ‘কঠোর লকডাউনের’ কারণে মসলার বাজারে এখনও উত্তাপ লাগেনি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিবছর কোরবানির ঈদের আগে চাহিদা বেড়ে যায় এবার উল্টো চিত্র, চাহিদা কমে গেছে। আগে যেসব ক্রেতা কেজিতে কেজিতে মসলা নিতো এখন আড়াইশ গ্রাম ৫০০ গ্রাম করে মসলা নিচ্ছে। জানতে চাইলে বলে বেচতে না পারলে নিয়ে কী করবো? এছাড়া চলমান লকডাউনে বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় হোটেল-রেস্তোরাঁয় মসলার চাহিদা কমে গেছে। ‘লকডাউনের’ জন্য মফসলের ক্রেতারা আসতে পারছেন না। এ সময়ে মৌলভীবাজার ও চকবাজারের মসলার দোকানগুলোতে দম ফেলার ফুসরত থাকে না। সেখানে দুই/চারটা কাস্টমার দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা মুশকিল। এখন যেসব ক্রেতা আসছেন, তারা রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের খুচরা বিক্রেতা। আর ব্যক্তিপর্যায়ের ক্রেতারা পাড়া-মহল্লা থেকে পরিবারের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই সংগ্রহ করছেন। ফলে চাহিদা একেবারেই কমে গেছে যা আমদানিকারকদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করেছে বলেও জানান তারা।
শনিবার (১০ জুলাই) দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারী মসলার বাজার পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এবছর মৌলভীবাজারে মসলার দাম স্থিতিশীল রয়েছে। মৌলভীবাজার থেকে কম দামে মসলা কিনতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রেতারা ভিড় করতো। এখন শুধু রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার খুচরা ব্যবসায়ীরা মসলা নিচ্ছেন। কিন্ত নেই ব্যক্তিপর্যায়ে মসলা কেনার তোড়জোড়। ‘লকডাউনের’ জন্য মফসলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ক্রেতারা আসতে না পাড়া ও সামাজিক অনুষ্ঠানসহ দাওয়াত কমে যাওয়ায় মসলার চাহিদা কমে গেছে। মসলার দোকানেগুলোতে ভিড় লক্ষ্য করা যায়নি। বিক্রেতারা নিরিবিলি সময় পার করছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পাইকারী গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এনায়েত উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর চাহিদা বেড়ে গেলে, মসলার দামও বাড়ে এটা সত্য, কিন্তু গত দুই বছর বাড়েনি। এবছর দাম স্থিতিশীল রয়েছে। কারণ ‘লকডাউনের’ কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা এখানে আসতে পারছে না। এছাড়া সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান, ইফতারপার্টি, বিয়ে, জন্মদিন সব কিছু বন্ধ। ফলে চাহিদা তলানিতে নেমেছে।
তিনি বলেন, এবছর পর্যাপ্ত আমদানি হয়েছে। আমদানি করা সব মসলা সময়ের আগেই চলে এসেছে। তাই পর্যাপ্ত মজুদ আছে। এবছর যারা আমদানি করেছিল তারা বিক্রি করতে না পেরে ঋণখেলাপি হওয়ার পথে। গুদামে মসলার প্রচুর মজুদ। ফলে দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। ‘লকডাউনের’ কারণে ক্রেতারা আসতে পারছেন না। তাই বিক্রি কম। আর কম বিক্রি হলে ব্যবসায়ীরা মারা পড়বেন।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক হাজী মো. আবুল হাসেম বাংলানিউজকে বলেন, ‘লকডাউনের’ জন্য ব্যবসায়ীরা দুঃসময় পার করছেন। ক্রেতারা আসতে না পাড়ায় চাহিদা তলানিতে পড়েছে। দেশের মসলার বাজার মূলত আমদানি নির্ভর হওয়ায় তা বিদেশের বাজার পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। অনেকে ক্ষেত্রে ভারতের বাজারে দাম কম থাকলে তা আমাদের বাজারে প্রভাব পড়ে। এবছর আন্তর্জাতিক বাজার আপাতত অস্থিতিশীল।
তিনি বলেন, আমরা ‘লকডাউনের’ পক্ষে কিন্তু, সরকারকেতো ব্যবসা বাণিজ্যের কথা চিন্তা করতে হবে। ১৪ দিনের ‘লকডাউন’ দেওয়ার পর সরকারের উচিত হবে মাস্ক ব্যবহার ও স্যানিটাইজার ব্যবহারের বিষয়টি কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে। দেড় সপ্তাহ পরে কোরবানির ঈদ। তাই ঈদের আগে যদি স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে সব ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করতে দেয় তাহলে ব্যবসায়ীদের জীবন ও জীবিকা বেঁচে যাবে।
হেদায়েত অ্যান্ড ব্রাদাস মসলা স্টোরের ম্যানেজার মো. নাজিমউদ্দীন বাংলানিউজকে বলেন, কোরবানি ঈদের আগে খুচরা ব্যবসায়ীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও মৌলভীবাজার থেকে মসলা কিনতে দেখা যেতো। ‘লকডাউনের’ জন্য এবছর সে রকম কোনো ক্রেতা নেই। চাহিদা কমে গেছে। তাই দুই/তিন মাস আগের দামেই সব ধরনের মসলা বিক্রি হচ্ছে।
মুন্সিগঞ্জ থেকে মসলা কিনতে মৌলভীবাজারে এসেছেন খুচরা মসলা ব্যবসায়ী ফারক আমিন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, লকডাউনে ব্যবসা শেষ। আজ ঢাকায় আসতে খরচ হয়েছে প্রায় ৫০০ টাকা। ‘লকডাউনের’ আগে খরচ হতো ১০০ টাকা। এছাড়া বাসে করে মসলা নিতাম এতে ২/৩শ টাকা দিলেই হতো। এখন ভ্যান ভাড়া করতে হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা দিয়ে। সামনে ঈদ তাই কিছু মসলা নিতে এসেছি। আগে প্রতিদিন ৫ কেজি মসলা বিক্রি হতো এখন সেখানে ২ কেজি বিক্রি হচ্ছে। যে মানুষ আগে আধা কেজি মসলা নিতো সে এখন ১০০ গ্রাম মসলা নিচ্ছে। কারণ আগের মতো আর সামাজিক অনুষ্ঠান হচ্ছে না, এক আরেক জনের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে না। বিয়ে সাদি কমে গেছে। তাই আমাদের ব্যবসাও কমে গেছে।
মৌলভীবাজারে প্রতিকেজি জিরা প্রকারভেদে পাইকারী বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩৬০ টাকা, এলাচ ২০০০ থেকে ৩২০০ টাকা, দারুচিনি ২৭০ থেকে ৩৪০ টাকা, লবঙ্গ ৯৮০ টাকা, জায়ফল ৭০০, গোলমরিচ সাদা ৮০০, কালো ৪৪০, কিসমিস ২০০ থেকে ২৪০, আলুর বোখরা ৪৮০, চিনা বাদাম ১০০, আখরোট প্রতিকেজি ৭৫০ টাকা, কাঠবাদাম ৫৭০, কাজু বাদাম ৫৭০ থেকে ৮০০, পেস্তাবাদাম ১২০০ থেকে ১৬০০, শাহীজিরা ২০০ টাকা, মিষ্টিজিরা বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এদিকে পরিবহন ব্যয় বাড়লেও খুচরা বাজারেও আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের মসলা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে মসলা আনতে খরচ হতো ৫০০ টাকা এখন আনতে খরচ হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। আমরা কম দামে কিনছি কিন্তু পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়া আর দাম কমানো যাচ্ছে না। কোনো কোনো পণ্যে তো লোকসান দিতে হচ্ছে। তাই খুচরা বাজারে আগের দামেই সব ধরনের মসলা বিক্রি হচ্ছে।
সূত্রাপর কাঁচাবাজারের বিসমিল্লাহ স্টোরের ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের মসলা। বর্তমানে দারুচিনি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজিতে। এলাচ মান ও প্রকারভেদে প্রতিকেজি ২২০০ থেকে ৩২০০ টাকা, জিরা ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা, কাঠবাদাম কেজি ৬০০ টাকা। কাজুবাদামের কেজি ৮০০ টাকা। কিসমিস বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা কেজিতে। লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা কেজি। জায়ফল ১৫০০ টাকা কেজি। লবঙ্গ কেজি ১০০০ টাকা।
সরকারি বাজার মনিটরিংয়ে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, মসলার দাম আগের বছরের তুলনায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ২০১৯-২০২০ সালের তুলনায় ২০২০-২০২১ সালে গরম মসলার দাম কমতির দিকে। প্রতিকেজিতে ৬০ ও ৫২ শতাংশ দাম কমেছে। লবঙ্গ প্রতি কেজি ৮০০ থেকে ৯৬০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে, যা গত বছর ছিল ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত। এ হিসাবে দাম কমেছে ২২ শতাংশ। প্রতিকেজি ছোট এলাচ ২৪ শতাংশ কম দামে ২ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১১ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০২১
জিসিজি/এএটি