ঢাকা: দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে বিদেশি বিনিয়োগকারী, ঋণদাতা ও কর্মীদের দেওয়া অতিরিক্ত কর ছাড়ের মত আর্থিক প্রণোদনা বাতিল করার দাবি জানিয়েছে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।
এধরণের কর ছাড়ের পরিবর্তে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত সাধারণ কর আরোপের পরামর্শ দিয়েছে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিমউদ্দিন।
কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিরা বলছেন, এফবিসিসিআইর চাওয়া পূরণ হলেও এতে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। এধরণের প্রস্তাব সরকারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
অন্যদিকে সরকারের প্রতিনিধিরা বলছেন, সরকার বিভিন্ন সময় বিদেশি বিনিয়োগ আনতে কিছু সুবিধা দিয়েছে। বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এসব সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রয়োজন আছে কি-না সেবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বৈষম্য করা উচিত নয়। বাড়তি সুবিধা দিয়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনায় সরকার লাভবান হচ্ছে কি-না সেটাও বিবেচনা করা দরকার।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়ন হওয়ার কারণে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে এফবিসিসিআই। প্রতিবেদনে টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
শিগগিরই প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিক ভাবে সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে এফবিসিসিআই সূত্র।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিমউদ্দিন বলেন, আমরা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা চাই।
বিদেশিরা বর্তমানে যেসব আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন তারমধ্যে আটটটি উল্লেখ করে দেশি-বিদেশি উভয় ব্যবসার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য কী ধরণের উদ্যোগ নেওয়া উচিত সে সম্পর্কে সুপারিশ করেছে এফবিসিসিআই।
জানা গেছে, আর্থিক প্রণোদনার অধীনে বিদেশি বিনিয়োগকারী, ঋণদাতা ও শ্রমিকরা বেতন, প্রযুক্তি জ্ঞান এবং বিদেশি ঋণের সুদ এবং বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলোর শেয়ার স্থানান্তর মাধ্যমে পাওয়া মূলধনের ওপর কর অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছেন।
এছাড়াও অনুমোদিত শিল্পে নিযুক্ত প্রবাসী শ্রমিকদের তিনবছর পর্যন্ত আয়কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কর সুবিধা দেওয়ার জন্য ৩৪টি দেশের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে।
এফবিসিসিআই’র প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আয় যেখানেই হোক সেখানে কর দিতে হবে। বর্তমানে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো ১৫ বছরের জন্য আয়কর অব্যাহতি পেয়েছে। এসব কোম্পানিতেও স্বাভাবিক কর আরোপের প্রস্তাব করেছে এফবিসিসিআই।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যন্ত্রপাতি, খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ার পাশাপাশি বিমার ক্ষেত্রে তারা অতিরিক্ত সুবিধা পাচ্ছেন। এছাড়াও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নিবন্ধনের ক্ষেত্রে দলিল করার স্ট্যাম্প শুল্ক দেওয়া থেকে অব্যহতি পান।
এসব ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কোনো ধরণের বৈষম্য না করার পরামর্শ দিয়েছে দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠনটি।
এ বিষয়ে এফবিসিসিআই’র ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ পলিসি বিষয়ক উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ বলেন, বিশ্বব্যাপী দেশি বিনিয়োগকারীরা বাড়তি সুবিধা পান। কিন্তু বাংলাদেশে তার বিপরীত। তারপরও বিদেশি বিনিয়োগ তেমন বাড়েনি। তাই আমরা সবার জন্য সমান সুবিধা চাই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য (কর নীতি) মো. আলমগীর হোসেন, অতীতের সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুবিধা দিয়েছে। যেমন, বিদ্যুৎখাত এবং পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করার জন্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহী করার জন্য আর্থিক সুবিধা দেওয়া। তবে আগামী দেড় বছরের মধ্যে এসব সুবিধার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।
এফবিসিসিআই’র উপদেষ্টা আরও বলেন, দেশি বিনিয়োগকারীরা যেখানে পিছিয়ে আমরা কেবল সেখানে বিদেশি বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে সরকার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির যুগ্ম মহাসচিব আল মামুন মৃধা বলেন, সরকারের সঙ্গে আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আনতে বিশ্বব্যাপী কাজ করছি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আর্থিক সুবিধা বাতিল করা হলে কষ্ট পাবো।
তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকা উচিত নয়। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ থেকে আমরা সত্যিই উপকৃত হচ্ছি কি-না সেটাও দেখতে হবে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে বলেন তিনি।
এফবিসিসিআই’র প্রস্তাবনায় বিনিয়োগের প্রয়োজনীয় ও প্রধান শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে, বিধিবিধান সহজ করার জন্য ওয়ানস্টপ সেবা কেন্দ্র চালু ও প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা, নিবন্ধর কার্যক্রম সহজ করা, মানব সম্পদ উন্নয়ন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠার খরচ কমানো। বিনিয়োগ পরবর্তী সুবিধা নিশ্চিত করা।
ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রকাশিত সবশেষ বিনিয়োগ তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে দেশে সরাসরি বিনিয়োগ প্রবাহ ছিল ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। যা ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ১১শতাংশ কম। গত ছয়বছরের এফডিআইর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিবছরই গড় এফডিআই ছিল ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০২২
এসই/এনএইচআর