ঢাকা: গ্রাহকদের মোটা অংকের ছাড় দেওয়ার অবিশ্বাস্য প্রলোভন দেখিয়ে দেশের বিতর্কিত ২৫টি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম গেল বছরের চার মাসে ৬ হাজার ৫০ কোটি টাকার অর্ডার নিয়েছিল।
অর্থনীতির ভাষায়, এ ধরনের ব্যবসাকে পঞ্জি স্কিম বলা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশদ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার চিত্র উঠে এসেছে, যা দেশের বিকাশমান ই-কমার্স ব্যবসাকে বিতর্কিত করেছে।
সাধারণত, বাংলাদেশের ই-কমার্স এবং ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসায়ীরা মাসে ৫০০-৫৫০ কোটি টাকার লেনদেন করেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে শুধুমাত্র ২৫টি প্রতিষ্ঠানের কারণে লেনদেন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০৫০ কোটি টাকায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত ২৫টি ইকমার্স প্ল্যাটফর্ম চিহ্নিত করেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, তার মধ্যে রয়েছে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, কিউকম, ধামাকা, আলাদিনেরপ্রদীপ, সিরাজগঞ্জশপ, আলেশামার্ট এবং দালালপ্লাস। এসব প্রতিষ্ঠান পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছে তাদের ব্যাংক হিসাবে।
ইকমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো এমন কার্য্ক্রম চালিয়েছে যেগুলোকে পঞ্জি স্কিমের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, একটি বিনিয়োগ জালিয়াতি পদ্ধতি যা নতুন গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ পুরনো গ্রাহকদের প্রদান করে। এমন প্রতারণার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক গেল বছরের ৩০ জুন গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহ করার পরে ইকমার্স প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অর্থ ছাড় করতে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটরদের নির্দেশ দেয়।
প্রতারক ইকমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর অর্থ-আত্মসাত থেকে গ্রাহকদের রক্ষা করাই এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনার ফলে লেনদেনের পরিমাণ কমে গেছে। গেল বছরের ১ জুলাই থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যান্ত লেনদেনে নেমে এসেছে ৫০৬ কোটি টাকায়। এতে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক অগ্রিম অর্থ প্রদান করেও পণ্য পাননি। এটি ই-কমার্স খাতকে একটি ধাক্কা দিয়েছে, যা অসঙ্গতিগুলো সামনে আসার আগে একটি বিপজ্জনক গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
ই-কমার্স সাইটগুলো মূলত গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেছে পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে। যেমন সফটওয়্যার শপ লিমিটেড (এসএসএল), নগদ, ফস্টার কর্পোরেশন, বিকাশ এবং সুর্যমুখী পে লিমিটেডের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন পদক্ষেপের পর পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে যায় ৫৬১ কোটি টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে অর্থ ছাড়ের উদ্যোগ নেওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা ২৪ জানুয়ারি থেকে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা ফেরত পেয়েছেন।
গেল বছরের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো এসএসএলের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে ২৭৪৬ কোটি টাকার তহবিল পেয়েছে।
৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত কোম্পানিটির কাছে প্রায় ৮৯ কোটি টাকা আটকে ছিল। এটি ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত গ্রাহকদের প্রায় ১৫ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে।
মার্চ থেকে জুনের মধ্যে গ্রাহকরা নগদের মাধ্যমে ১৮৪০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন। বর্তমানে, প্রায় ২০ কোটি টাকা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা কোম্পানিটির কাছের আটকে আছে।
চার মাসে ফস্টার কর্পোরেশনের মাধ্যমে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো পেয়েছে ৮২৯ কোটি টাকা। ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত গেটওয়ের কাছে প্রায় ৩৮৩ কোটি টাকা আটকে ছিল। এ প্রতিষ্ঠান ১৫ মার্চ পর্যন্ত গ্রাহকদের ৪২ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে।
দেশের সবচেয়ে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে ৩৫২ কোটি টাকা পেয়েছে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো। এখন প্রায় ৫ কোটি টাকা বিকাশের কাছে আটকে আছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়টি অনেক জটিল। কারণ অনেক গ্রাহক একক অর্ডারে কেনা পণ্যের জন্য ব্যাংক হিসাব এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করেছেন।
প্রতিটি মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে লেনদেনের সীমা ৩ লাখ টাকায় সীমাবদ্ধ, তাই কোনও ব্যবহারকারী কোন পণ্য কেনার সময় সীমা অতিক্রম করতে পারেন না। ‘সুতরাং, গ্রাহকরা ইতোমধ্যে পণ্য পেয়েছেন কিনা তা আমাদের যাচাই করতে হবে। ’
খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সময়মতো কঠোর ব্যবস্থা নিলে, কেলেঙ্কারিগুলো আরও আগেই রোধ করা যেত। ’
তারা বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের জন্য তহবিল ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ প্ল্যাটফর্মগুলো একটি ব্যবসায়িক মডেল চালায়। যা নতুন গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বিদ্যমান গ্রাহকদের পণ্য প্রদান করে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০২২
এসই/এএটি