গভীর সমুদ্রে পড়ন্ত বিকালের সূর্যের রক্তিম আভা দোল খাচ্ছে। সঙ্গে আছড়ে পড়ছে সফেদ ঢেউ।
গাঢ় কালো অবয়বের বিশালাকার এ জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে দুই বছরে শতবার লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস-এলপিজি স্থানান্তর করার গৌরব অর্জন করল বসুন্ধরা গ্রুপ। চলতি বছরের শুরুতে এ গৌরব অর্জন করে ‘বসুন্ধরা এলপিজি চ্যালেঞ্জার’। এবার এগোচ্ছে নতুন মাইলফলক স্পর্শের দিকে।
শততম শিপ টু শিপ স্থানান্তর করা গ্যাস প্রক্রিয়াজাত করে বিপণন হবে দেশে। ব্যবহার হবে শিল্পকারখানায়। উৎপাদন হবে পণ্য। সমৃদ্ধ হবে দেশের উৎপাদন খাত। উৎকর্ষতা আসবে জাতীয় অর্থনীতিতে।
জানা যায়, সমুদ্রপথে বিদেশ থেকে এলপি গ্যাস পরিবহন এবং শিপ থেকে শিপে স্থানান্তর কার্যক্রম অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজটিই আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে দেড় বছরে শতবার সুসম্পন্ন করার গৌরব অর্জন করল দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত বসুন্ধরা গ্রুপ। এখন নতুন স্বপ্ন ছোঁয়ার অপেক্ষায়। তবে নতুন স্বপ্ন ছোঁয়ার লক্ষ্যে ২৮ মার্চ বসুন্ধরা এলপিজি চ্যালেঞ্জার (মাদার ভেসেল) পরিদর্শনে যান বসুন্ধরা গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরিদর্শন দলে নেতৃত্ব দেন বসুন্ধরা গ্রুপের চিফ অপারেটিং অফিসার ক্যাপ্টেন রুহুল আমিন। একই সঙ্গে গভীর সমুদ্রে ঝুঁকি মোকাবিলা করে শিপ থেকে শিপে গ্যাস স্থানান্তর কার্যক্রম পরিদর্শনে যান সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর এ জেড এম জালাল উদ্দিন, মহাপরিচালকের একান্ত সচিব রাশেদুল আলমসহ সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের সামনে যাত্রীবাহী জেটি থেকে টাগবোট সকাল ৯টায় যাত্রা করে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে দুপুরে। সেখানে পৌঁছার পর কর্মকর্তাদের এলপিজি চ্যালেঞ্জারে স্বাগত জানান ইউক্রেনীয় নাগরিক ক্যাপ্টেন ভিটালি সাইহোরোদস্কি।
সরেজমিন দেখা যায়, ২২৭ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩৬ মিটার প্রস্থের বিশাল জাহাজটি নীল জলরাশির ঢেউয়ের তালে তালে নৃত্য করছে। বিশাল সমুদ্রের দৃষ্টিসীমায় অন্য কোনো জাহাজ দেখাও যাচ্ছে না। স্বচ্ছ নীল জলরাশিতে ঢেউয়ের তালে নৃত্য করে জাহাজটি যেন বাংলাদেশেরই জয়গান ঘোষণা করছে- ‘আমিই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ও বৃহৎ এলপি গ্যাস বহনকারী জাহাজ। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছি আমিই। ’ এমন জয়ধ্বনি শোনানোর প্রমাণ পাশেই রেখেছে এলপিজি চ্যালেঞ্জার। পাশেই আগলে রেখেছে এলপিজি সোফিয়াকে। এলপিজি চ্যালেঞ্জার বিদেশ থেকে গ্যাস পরিবহন করে আনে প্রায় ৮২ হাজার ঘনমিটার। সেখান থেকেই এলপিজি চ্যালেঞ্জার থেকে সোফিয়ায় স্থানান্তর করছে (শিপ টু শিপ ট্রান্সফার) ৭ হাজার ঘনমিটার। সমুদ্রের স্রোত ও তর্জন-গর্জনের মধ্যে শিপ টু শিপ গ্যাস স্থানান্তর একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। সামান্য ভুলেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি সুচারুরূপে এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিধি মেনে সম্পন্ন করেন দুই জাহাজের কর্মীরা।
বসুন্ধরা এলপিজি চ্যালেঞ্জারে দেখা যায়, বিশালাকার জাহাজটির (মাদার ভেসেল) পাশে ছোট্ট এলপিজি সুফিয়া যেন কন্যা। বড় জাহাজের পেট থেকে ছোট্ট জাহাজে গ্যাস স্থানান্তর হচ্ছে পাইপের মাধ্যমে। গ্যাস স্থানান্তরের পর দুই জাহাজের দুই ক্যাপ্টেনকে দেখা গেল ব্যস্ত সময় পার করতে। পাশাপাশি বাঁধা দুটি জাহাজ গ্যাস স্থানান্তরের পর জাহাজের গ্যাসপাইপ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ, রশি খুলে বন্ধনমুক্ত করা এবং নিরাপদে মোংলা বন্দরের পথে রওনা দিচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপের ভাড়া করা আরেক জাহাজ এলপিজি সোফিয়া। স্থানান্তর কাজটি দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে বসুন্ধরা এলপিজি চ্যালেঞ্জারের ক্যাপ্টেন ভিটালি সাইহোরোদস্কি ওয়াকিটকির মাধ্যমে ধন্যবাদ জানান এলপিজি সোফিয়ার ক্যাপ্টেনকে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করার পর তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে ক্যাপ্টেন ভিটালি সাইহোরোদস্কির মুখে। তারপর যান ওই জাহাজ পরিদর্শনকারী দল নেতা ক্যাপ্টেন রুহুল আমিনের কাছে। জাহাজ পরিদর্শনে যাওয়া বসুন্ধরা কর্মকর্তাদের তিন ভাগে ভাগ করে দেখালেন পুরো জাহাজ। জাহাজের পরিচালনা কার্যক্রম থেকে শুরু করে ইঞ্জিন পর্যন্ত প্রায় সব তথ্যই তিনি নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করলেন ক্যাপ্টেন রুহুল আমিন ও তাঁর দলের কাছে।
ক্যাপ্টেন ভিটালি সাইহোরোদস্কির তথ্যানুযায়ী বিদেশ থেকে ৮২ হাজার ঘনমিটার এলপি গ্যাস নিয়ে জাহাজটি কুতুবদিয়ার অদূরে বহির্নোঙরে অবস্থান নেয়। জাহাজটির চলাচলে ১২ মিটারের বেশি গভীরতা প্রয়োজন হয়। এ কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে যেতে পারছে না এটি। ফলে বহির্নোঙর থেকেই ছোট আকারের শাটল ট্যাংকারের মাধ্যমে গ্যাস খালাস করেন কর্তৃপক্ষ।
পরিদর্শন শেষে সন্তোষ প্রকাশ করে ক্যাপ্টেন রুহুল আমিন বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ এলপি গ্যাস পরিবহনকারী জাহাজ পেয়েছে। দেশের লাল-সবুজের পতাকাবাহী জাহাজটি বাংলাদেশের গৌরব বাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের গ্যাস সংকট দূরীকরণ ও শিল্পায়নে সর্বাত্মক ভূমিকা রাখছে জাহাজটি। বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানায় আসার পর জাহাজটি গত জানুয়ারিতেই শিপ টু শিপ গ্যাস স্থানান্তরের শততম মাইলফলক স্পর্শ করেছে। এখন নতুন মাইলফলকে পৌঁছতে কাজ করছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপটি। এই লক্ষ্যে বসুন্ধরা এলপিজি চ্যালেঞ্জার অনন্য ভূমিকা পালন করছে। দেশের অর্থনীতি ও শিল্প বিকাশে অবদান রাখছে।
তিনি বলেন, এখন বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের জাহাজ পরিচালনার জন্য মেরিন একাডেমি ও ন্যাশনাল মেরিন ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নাবিকদের নিয়োগ দিচ্ছে। এতে কর্মসংস্থানও বাড়ছে।
পরিদর্শন দলে বসুন্ধরা গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন শেখ ইহসান রেজা, মাহবুব আলম, মো. বেলাল হোছাইন, এম এম জসিম উদ্দিন, মো. আবদুস শুক্কুর, সাদ তানভীর, সৈয়দ ফরহাদ আলী রেজা, মো. জাকারিয়া জালাল, সরওয়ার হোছাইন সোহাগ, রিদওয়ানুর রহমান, নাসির উদ্দিন, মোস্তফা কামাল, ক্যাপ্টেন মোফিক আহমেদ, আশিক ইমরান, আবদুল্লাহ তাসনীফ প্রমুখ।
এ ছাড়া জাহাজ পরিদর্শনে বসুন্ধরার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছিলেন টাগবোট প্রান্তিক সরওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী গোলাম সরওয়ার, ইন্টারপোর্টের তানজীল আহমেদ রুহুল্লাহ, আইএমএস গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার আবু ও খায়ের আহমদ।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২২
নিউজ ডেস্ক