বগুড়া: ঈদুল ফিতর উপলক্ষে পাল্লা দিয়ে কাজ করে চলেছেন সেমাইপল্লির কারিগররা। তৈরি করছেন চিকন সাদা সেমাই।
শনিবার (২৩ এপ্রিল) বগুড়ার সেমাইপল্লি খ্যাত বেজোড়া, শ্যামলা কাথিপাড়া, কালসিমাটি, রবিবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেমাই তৈরিতে শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ।
সরেজমিনে দেখা যায়, গামলাভর্তি ময়দা নিয়ে বসেছেন শ্রমিকরা। পাশেই বিদ্যুৎ চালিত সেমাই তৈরির মেশিন। কারখানায় ঢোকার আগেই প্রসেসিং করে নিয়েছে ময়দা। সেই ময়দা মেশিনের নির্দিষ্ট স্থানে ফেলছেন তারা। সময়ের ব্যবধানে মেশিনের নিচ দিয়ে বেরিয়ে আসে চিকন সেমাই। পরে সেগুলো বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। ত্রিফল বা পাটের বস্তা বিছিয়ে তার ওপর শুকানো হয়। সেমাইয়ের ভাঁজে ভাঁজে বিশেষ ধরনের শলাকা ব্যবহার করে তা উল্টে-পাল্টে দেওয়া হয়। বেজোড়া একটি গ্রামের নাম। শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা ইউনিয়নে গ্রামটির অবস্থান। এ গ্রাম থেকেই চিকন সাদা সেমাইয়ের জন্ম। স্বাধীনতার পর থেকেই এ গ্রামের কয়েকটি পরিবার চিকন সেমাই তৈরি শুরু করেন। তবে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানা যায়নি। সময়ের ব্যবধানে এ শিল্প বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে এখানকার তৈরি চিকন সাদা সেমাইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে। সারা বছরই কমবেশি করে সাদা সেমাই তৈরি করা হয় গ্রামটিতে। প্রত্যেক বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহায় রেকর্ড পরিমাণ সেমাই তৈরি করেন কারখানার মালিক-শ্রমিকরা।
প্রতিবছর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রমজান মাসে সাদা সেমাইয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে বলে এসময় এর উৎপাদনও বেড়ে যায়। কিন্তু গেল দুই বছর করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংকটময় সময়ে সেমাই উৎপাদনে টানা পড়ে। এতে হালিমা, পারুল, জাহানারা, পারভীন, নাসিমার মতো অসংখ্য নারী শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন।
তবে এ বছর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রমজানের শুরুর আগে থেকেই সেমাইপল্লিগুলো ব্যস্ত হয়ে ওঠে। চিকন সাদা সেমাই তৈরিতে পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয় মালিক ও কারিগরদের কর্মযজ্ঞতা। বর্তমানে তাদের দম ফেলার যেন ফুসরত নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শাজাহানপুর উপজেলার বেজোড়া গ্রামে এ শিল্প যারা আনে তাদের মধ্যে অন্যতম দুলু মিয়া। তিনি প্রায় ২২ বছর আগে মারা গেছেন। বর্তমানে তার স্ত্রী সাহেরা বেওয়া স্বল্প পরিসরে হলেও এ পেশা ধরে রেখেছেন। মূলধনের অভাবে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা থাকার পরও তিনি এ শিল্পকে বড় করতে পারছেন না।
সদর ও শাজাহানপুর উপজেলায় প্রায় ১০-১২ গ্রামে গড়ে উঠেছে সেমাইপল্লি। এ গ্রামে শতাধিকের মতো সাদা সেমাই তৈরির কারখানা রয়েছে। কারখানাগুলোতে কাজ করেন প্রায় ছয় থেকে সাত শতাধিক শ্রমিক। তাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশই নারী। সংসারে বাড়তি আয়ের আশায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সেমাই কারখানার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখেন ওই গ্রামগুলোর নারী শ্রমিক। নারী শ্রমিকের হাতের ছোঁয়ায় ময়দা থেকে তৈরি হয় চিকন সাদা সেমাই। আর দেশজুড়ে রয়েছে এ সেমাইয়ের কদর। শাজাহারপুর উপজেলার নিশচিন্তপুর গ্রামের সেমাই কারখানার মালিক রফিকুল ইসলাম, জোনায়েদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবছর রমজানের আগে থেকে কারখানায় প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কর্মযজ্ঞ চলে। রমজানের রোজা অর্ধেকের বেশি চলে গেছে। এখন সেমাইপল্লির কারখানাগুলো ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ঈদকে সামনে রেখে প্রত্যেক কারখানায় গড়ে প্রতিদিন প্রায় চার-পাঁচশ কেজির মতো ময়দা থেকে সাদা সেমাই তৈরি করা হয়। এর পরিমাণ প্রায় ২০-২২ খাঁচি। নিশচিন্তপুর এলাকার আব্দুল খালেক বাংলানিউজকে জানান, তার কারখানাতেও কাজ করেন ৭-১০ জন নারী শ্রমিক। ঈদ বাজারে তার কারখানায় ৫০ কেজি ওজনের ৩৫০-৪০০ বস্তার মতো ময়দার সেমাই তৈরি হয়ে থাকে। বগুড়ায় উৎপাদিত এ চিকন সেমাই কিনতে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে ব্যাপারিরা বগুড়ায় আসেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা জেলা শহরের প্রতিনিয়ত ট্রাকযোগে সেমাই নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা।
সাহেরা, শিল্পী বেগমসহ একাধিক নারী শ্রমিক বাংলানিউজকে জানান, তাদের অভাবের সংসার। স্বামীর একার আয়ে সংসার চলানো কষ্টকর। তাই সারা বছরই তারা সেমাই কারখানায় কাজ করেন। তবে গেল দু’বছর করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংকটময় সময়ে সেমাই উৎপাদনে টানা পড়ে। এসময় বন্ধ ছিল সিংহভাগ কারখানা। আর এতে অনেকেই কাজ না থাকায় খুব কষ্টে দিনগুলো কাটে। তারা জানান, আল্লাহর রহমতে এ বছর প্রায় সব কারখানাগুলোতে সেমাই তৈরির কাজ চলছে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাতে সেমাই কারখানায় কাজের চাপ বেশি হয়। প্রত্যেক বছরের ঈদুল ফিতরের আগ মুহূর্তে বিশেষ করে রমজানের কিছুদিন আগে থেকে এ পেশার সঙ্গে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক যুক্ত হয়ে পড়েন। এ সময় প্রতিটি কারখানায় সেমাই উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
তারা আরও বলেন, প্রত্যেকটা কারখানায় তাদের পারিশ্রমিক আসে সেমাই তৈরির ওপর। নারী শ্রমিকরা দলবদ্ধভাবে সেমাই কারখানাগুলোতে কাজ করেন। এক বস্তা (৫০ কেজি) ময়দার সেমাই বানিয়ে তারা পারিশ্রমিক পান ১২০-১৪০ টাকা। দিনে ৫-৬ জনের একটি দল ১০ থেকে ১৪ বস্তা ময়দার সেমাই তৈরি করা যায়। এতে যা পয়সা পাওয়া যায় সমানভাবে ভাগাভাগি করে নেন তারা।
সব মিলিয়ে গেল দু’বছর মন্দা কাটিয়ে এ বছর সেমাইপল্লির প্রায় প্রতিটি কারখানাতে সেমাই উৎপাদন বেড়ে গেছে। বেড়েছে চাহিদা, সেসঙ্গে ঘুরছে মেশিন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন জেলায় সেমাই সরবরাহও করতে পারছেন কারখানা মালিকরা।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২২
এএটি