চাঁপাইনবাবগঞ্জ: আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ। আর এ চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গত তিন বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভোক্তারা কম খরচে টাটকা আম পেয়েছেন।
করোনার কারণে দেশব্যাপী যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, তখনও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আম পরিবহনের জন্য ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ ছিল আম ও সবজি পাঠানোর একমাত্র মাধ্যম। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জই নয়, এ ট্রেনটি চালু হওয়ায় রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জ জেলাও আম ও সবজি পাঠিয়ে উপকৃত হয়েছে। কিন্তু চলতি বছর আমের মৌসুমের মধ্য সময় পেরিয়ে গেলেও অজ্ঞাত কারণে চালু হলো না ম্যাংগো স্পোশাল ট্রেনটি। এ নিয়ে জেলাবাসীর মধ্যে হতাশা লক্ষ্য করা গেছে।
জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল আম। এ আমের ওপরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল জেলার ৮০ ভাগ মানুষের রোজগার।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সূত্র মতে, জেলায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের আম গাছ রয়েছে প্রায় ৩২ লাখ। এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় প্রায় তিন লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন। যা সারা দেশের উৎপাদিত আমের ৩০ ভাগ। তিন বছর আগে আম পরিবহনে রাস্তায় হয়রানি ও পরিবহন খরচ বেশি, পণ্যের গুণগত মান ঠিক না থাকা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ওজন জটিলতার কারণে যখন আমচাষিরা আম নিয়ে হতাশ, ঠিক সে সময় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে জাঁকজমকভাবে চালু হয় ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন। এতে এক দিকে যেমন জেলার মানুষের উপকার হয়েছে, অন্য দিকে রাজস্ব আয় হয়েছে সরকারের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ রেল সূত্র জানায়, ২০২০ সালে আম পরিবহন হয় এক লাখ ৬৭ হাজার ৮২ কেজি এবং রাজস্ব আয় হয় দুই লাখ ১১ হাজার ৪৫৮ টাকা। ২০২১ সালে ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ চালু হলে আম পরিবহন হয় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৯৭৩ কেজি এবং রাজস্ব আয় হয় ১৩ লাখ ৪৪ হাজার ৯২০ টাকা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকা পর্যন্ত এক কেজি আম রেলের মাধ্যমে পরিবহনে খরচ হয় মাত্র এক টাকা ৩১ পয়সা। কিন্তু কুরিয়ারে ঢাকায় পাঠাতে খরচ ১৪ থেকে ১৮ টাকা। ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’টি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রতিদিন বিকেল ৪টায় ছাড়ে এবং ঢাকায় পৌঁছায় রাত ২টায়। প্রথমে ১ জুন ও পরে ৮ জুন এবারের ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ চালুর সম্ভাব্য তারিখ ছিল। জেলায় এ বছর আম উৎপাদন কম হলেও ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ চালু হলে আম পরিবহন বাড়বে এবং তাতে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে বলে আশাবাদ রেল বিভাগের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আমচাষি ইসমাইল খান শামিম জানান, ক্ষুদ্র আম ব্যবসায়ী ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আসা ছোট ছোট ব্যাপারীদের এবং অনলাইন ব্যবসায়ীদের চরম উপকার হয়েছে। বিশেষ করে যারা কুরিয়ারের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, তারা বেশি খুশি। কারণ কুরিয়ারে আমের গুণগতমান নষ্ট হয়ে যায়, খরচও লাগে বেশি। অনেক সময় প্রাপক আম পান না। আর এ অভিযোগ পেয়েও কুরিয়ার কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয় না।
অনলাইন আম ব্যবসায়ী জ্যাকি খান জানান, তাদের মত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা উপকৃত হলেও আম লোড-আনলোডে রেলওয়ের শ্রমিকদের দ্বারা হয়রানি বন্ধ, ট্রেনটির সময় পরিবর্তন ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে ওয়াগন বা বগি বাড়ানো হলে সরকারের এ উদ্যোগটি আলোর মুখ দেখবে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, রহনপুর রেলস্টেশনে দুইয়ের বেশি ট্রেন দাঁড়ানোর সক্ষমতা না থাকায় এবং ভারত থেকে পণ্যের রাজস্ব বেশি হওয়ায় রহনপুর স্টেশন থেকে এ বছর ম্যাংগো ট্রেন না নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে।
অন্যদিকে দুই দফা সময় নির্ধারণের পরও ট্রেনটি চালু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অ্যান্ড কর্মাসের পরিচালক শহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, গত বছর করোনার কঠিন সময়েও ট্রেনটি চালু ছিল। কিন্তু এবার এখনো এটি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলো না, যা সত্যিই হতাশার।
অপর আম ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম জানান, রাজশাহীর আম শেষের পথে। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিন/চারটি জাত ছাড়া সব জাতের আম বাজারে কেনা-বেচা শুরু হলেও এ ট্রেনটি চালু না হওয়ায় হতাশ তিনি।
আর নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ও জেলা জাসদের সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির জানান, অজ্ঞাত কারণে দুই দফা ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনের সম্ভাব্য সিডিউল ঘোষণার পরও তা চালু না হওয়া হতাশাজনক। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন।
আর রেলের রাজশাহী বিভাগীয় কমার্সিয়াল অফিসার মো. নাসির উদ্দিন জানান, আমের সময় কেবল শুরু হয়েছে। এ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শনিবারও (৬ জুন) কথা হয়েছে। এ নিয়ে রেলের মহাপরিচালক ও রেলমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হয়েছে। তবে সময় এখনো নির্ধারণ হয়নি। দ্রুতই সময় নির্ধারণ হবে। আর সময় ঠিক হলেই সাংবাদিকদের জানানো হবে।
তিনি আরও জানান, আদেশ পেলেই ট্রেনটি চালু করতে সক্ষম রেল কর্তৃপক্ষ। কারণ এর জন্য পর্যাপ্ত ওয়াগন ও ইঞ্জিন এরই মধ্যে বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
অপরদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিব খান বলেন, ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন কয়েক জেলার ট্রেন। তাই সবার দিক মাথায় রেখে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম ও অন্যান্য পণ্য লোড করা হয়। এরপরও কৃষকদের স্বার্থে রেল বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনে বগি বাড়ানোসহ পুনরায় সময়সূচি পরিবর্তন করা যাবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ২০২০ সালের ৫ জুন প্রথম ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। যা জেলার প্রথম স্টেশন রহনপুরসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার তিনটি স্টেশন এবং রাজশাহীসহ অন্তত চারটি জেলার আম ও সবজি পরিবহনে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশ সময়: ঘণ্টা, জুন ৮, ২০২২
এসআই