শেয়ারবাজারের আলোচিত বিনিয়োগকারী আবুল খায়ের হিরোর কারসাজি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানের কোম্পানির নাম। সেই সঙ্গে আছে আরও ১৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, সাকিবের কোম্পানি মোনার্ক হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগ আনা হয়েছে এবং জরিমানা করা হয়েছে। সাকিব ওই কোম্পানির চেয়ারম্যান।
তদন্ত প্রতিবেদনে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের শীর্ষ ক্রেতাদের মধ্যে সাকিব আল হাসানের নামও আছে। তবে তিনি এ শেয়ার কিনেছেন অন্য একটি ব্রেকারেজ হাউস থেকে।
যে সাত কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হয়েছে সেগুলো হলো ওয়ান ব্যাংক, বিডিকম অনলাইন, ফরচুন সুজ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, এশিয়া ইনস্যুরেন্স, গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স ও ঢাকা ইনস্যুরেন্স। এসব কোম্পানির শেয়ার দাম কৃত্রিমভাবে বাড়য়ে বিপুল মুনাফা তুলেছেন হিরো ও তার সহযোগীরা। আর হিরোর ভেলকিতে পড়ে এসব শেয়ার কিনে টাকা হারিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
বিএসইসির তথ্য অনুযায়ী, হিরো ও তার সহযোগীরা ২০২১ সালের জুন থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ধারাবাহিক লেনদেনের মাধ্যমে সাত কোম্পানির শেয়ার কারসাজি করেন। পুঁজিবাজারে বিএসইসির নির্দেশে ডিএসই গত বছরের ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বিডিকম অনলাইন ও ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ার কারসাজির অভিযোগ তদন্ত করে। তদন্তে শেয়ার কারসাজির প্রমাণ পায় ডিএসই। এ ধরনের সিরিজ লেনদেন সিকিউরিটিজ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ কারণে আবুল খায়ের হিরো ও তার স্ত্রী মোনার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিয়া, বাবা এবং তার সহযোগী ডিআইটি কো-অপারেটিভ লিমিটেডকে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। জরিমানার টাকা আদেশের ৩০ দিনের মধ্যে বিএসইসির ইস্যু করা ব্যাংক ড্রাফট-পে অর্ডারের মাধ্যমে জমা না করলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়।
গত ২ আগস্ট দেওয়া ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, আবুল খায়ের হিরো তার স্বজন-সহযোগীদের নিয়ে গত বছরের নভেম্বরে মাত্র ১৫ দিন ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন করে ১৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা মুনাফা তুলে নেন। নিজেদের মধ্যে শেয়ার কেনাবেচা করে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে এ মুনাফা করা হয়। এ কারসাজির জন্য হিরো তার নিজের, বাবা, স্ত্রী, বোন, বন্ধুবান্ধব ও অনুসারীদের ১৪টি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন। বিডিকমসহ বাকি কোম্পানিগুলোর শেয়ার দাম কারসাজির মাধ্যমে বাড়ালেও তারা মুনাফা তুলে নেয়নি। তা তাদের বিও হিসাবে জমা (আনরিয়ালাইজড) আছে। মানে সে শেয়ার তারা তখনো বিক্রি করেনি। অনাদায়ী এ মুনাফার পরিমাণ ছিল ১৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি সূত্র জানায়, হিরো, তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বাবা আবুল কালাম মাতবর, বোন কনিকা আফরোজ, শ্যালক কাজী ফরিদ হাসান এবং মোনার্ক হোল্ডিং, ডিআইটি কো-অপারেটিভ এবং দেশ আইডিয়াল ট্রাস্টের বিও অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কারসাজির মাধ্যমে সাতটি কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছে। হিরোর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান মোনার্ক হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
শেয়ার কারসাজির দায়ে অভিযুক্ত সাদিয়া হাসান গত বছরের ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বর ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের শীর্ষ ক্রেতা ছিলেন। মোনার্ক হোল্ডিংসের মাধ্যমেও এ শেয়ার কেনাবেচা করেন। তিনি তিন কোটি ৯৮ লাখ ২৯ হাজার ৯৩৬টি শেয়ার কিনেছেন এবং তদন্তের সময় ব্যাংকটির দু’কোটি ৩৩ লাখ ৫৬ হাজার ১১০টি শেয়ার বিক্রি করেছেন, যা এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকটির শেয়ারের মোট লেনদেনের ১৩.৬৪ শতাংশ। হিরোর বাবা আবুল কালাম মাতবর এবং বোন কনিকা আফরোজও সে সময় ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের অন্যতম ক্রেতা ছিলেন।
ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদন ও বিএসইসির জরিমানার আদেশ থেকে জানা যায়, ওই ১৫ দিনে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দাম সাড়ে সাত টাকা বা ৬০ শতাংশ বেড়ে যায়। ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দামে বড় ধরনের উত্থানের সময় শেয়ার কেনাবেচার সঙ্গে ১৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জড়িত ছিল বলে ডিএসইর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
হিরো, তার স্ত্রী, বাবা, বোন ছাড়া জড়িতদের মধ্যে রয়েছে হিরোর সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান ক্যান্ডেলস্টোন ইনভেস্টমেন্টস পার্টনার্স; মোনার্ক হোল্ডিংস, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানি জেনেক্স ইনফোসিস, ফরচুন সুজ ও সোনালি পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস; আবু নাসের দুলাল, খোরশেদ আলম এবং সানোয়ার খান।
হিরো জরিমানার টাকা জমা দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম গতকাল বলেন, জরিমানা কয়েকটি আদেশে হয়েছে। এর মধ্যে জরিমানার বেশির ভাগ অর্থ জমা হয়েছে, কিছু বাকি আছে। তিনি বলেন, তথ্য-প্রমাণসহ রিভিউ পিটিশনের সুযোগ আছে। তাতে কমিশন সন্তুষ্ট না হলে জরিমানা বাড়িয়েও দিতে পারে, আবার কমিয়েও দিতে পারে।
হিরোর কারসাজিতে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র বলেন, যেকোনো তদন্ত প্রতিবেদনে পারিপার্শ্বিক সব বিষয় তুলে ধরা হয়। কিন্তু যাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতায় সিকিউরিটিজ আইন ভঙ্গ হয় তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
আবুল খায়ের সমবায় অধিদপ্তরের উপরেজিস্ট্রার। ৩১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি এ পদে যোগদান করেন। ২০২০ সালের আগে তিনি স্টক মার্কেটে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিলেন। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় বীমা, শেয়ারের দাম, বিশেষ করে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের অস্বাভাবিক উল্লম্ফনের পরে তার নাম প্রথম সামনে আসে।
এ বিষয়ে জানতে আবুল খায়ের হিরোর ফোনে গতকাল রাতে কয়েক দফায় যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে কারচুপির বিষয়ে বিএসইসির নোটিশের লিখিত জবাবে আবুল খায়ের বলেছেন, আমরা কারসাজির জন্য শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করিনি। কিছু অবমূল্যায়িত শেয়ারে নতুন বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং নতুন বিনিয়োগের কারণে শেয়ারের দাম ও লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে।
জানতে চাইলে বিডিকম অনলাইন লিমিটেডের কোম্পানি সচিব এ কে এম কুতুব উদ্দিন গতকাল বলেন, আমাদের শেয়ার আমরা বাজারে ছেড়ে দিয়েছি। কারা আমাদের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করছে এটা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। কেউ যদি কারসাজি করে থাকে তাহলে সেটা দেখার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে। আমাদের শেয়ারহোল্ডারদের যাতে কেউ কারসাজি করে ঠকাতে না পারে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
শেয়ারবাজারে কারসাজি প্রসঙ্গে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী গতকাল বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে, বিএসইসি নিশ্চয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। একের পর এক কারসাজি হতে থাকলে পুঁজিবাজার ভালোর দিকে যাবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২২
জেডএ