ঢাকা: সমুদ্র জয়ের দুই বছর কেটে গেল। কিন্তু আজও আমরা সমুদ্রের দিকে তাকাতে পারিনি।
আক্ষেপের সুরে বাংলানিউজকে এ কথাগুলো বলছিলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমুদ্রসীমা বিষয়ক উইংয়ের প্রধান অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলম।
রোববার মন্ত্রণালয়ে নিজকক্ষে বাংলানিউজের দীর্ঘ আলাপচারিতায় খুরশেদ আলম কথা বলেন, সমুদ্রসীমার এই বিশাল সম্পদরাজি ও তার ব্যবহারে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে।
মায়ানমারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা লড়ে যে এক লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র জয় করেছে বাংলাদেশ, তার হাইড্রোলিক জরিপের কাজটি সম্পন্ন হয়, এই খুরশেদ আলমের নেতৃত্বে। তার মেধা ও একাগ্রতা বাংলাদেশকে পাইয়ে দিয়েছে নতুন ‘একটি বাংলাদেশ’।
আগামী ১৫ জুনের পর যে কোনো দিন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমুদ্রসীমা নিয়ে দীর্ঘ বিরোধের অবসান হবে। আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের রায় হবে। সেখানেও ইতিবাচক ফল আসবে বলে আশা করে বাংলাদেশ। অনেক বেশি প্রত্যাশা পোষণ করে আছেন খুরশেদ আলম নিজেও।
তবে যা পেয়েছি বা যা পাবো বলে আশা করি, তা নিয়ে যে বিশাল সমুদ্রদেশের মালিক হবে বাংলাদেশ, তার কতটুকুই বা ব্যবহার করা সম্ভব?
বাংলানিউজের এমন প্রশ্নের জবাবে খুরশেদ আলম বলেন, বাংলাদেশের আওতার মধ্যে যে বিশাল সমুদ্রসীমা রয়েছে, তার সঠিক ব্যবহার করা হয়নি। এখনও হচ্ছে না।
মায়ানমারের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতেই সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি হয়েছে উল্লেখ করে খুরশেদ আলম বলেন, বিশাল সমুদ্রসীমা পেয়েও বাংলাদেশ এ পর্যন্ত এর সঠিক ব্যবহার করতে পারেনি।
তিনি বলেন, শুধু সমুদ্রকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ উন্নতির চরম সীমায় পৌঁছাতে পারবে। সেজন্য চাই দূরদর্শী চিন্তা, পরিকল্পনা এবং সমুদ্র পানে যাত্রা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে বিশাল সমুদ্রসীমা রয়েছে, তার মধ্যে মাত্র দুটি সম্পদ ব্যবহার করি- মাছধরা, আর জাহাজ চালানো। জেনে আশ্চর্য হবেন, এ ক্ষেত্রেও আমরা খুব একটা এগুতে পারছি না।
খুরশেদ আলম জানান, ৬০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয় সমুদ্র দিয়ে। ২,৬০০ জাহাজ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় যাওয়া-আসা করে। এর মধ্যে বাংলাদেশের নিজের রয়েছে, মাত্র ৭০টি জাহাজ।
প্রতিবছর সাগর থেকে বাংলাদেশ মাত্র দশমিক ২৯ মিলিয়ন টন মাছ আহরণ করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। অথচ এ অঞ্চলে ভারত, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি মাছ ধরে নিয়ে যায়। এর পরিমাণ ৬ মিলিয়ন টন, পরিসংখ্যান জানালেন এই সমুদ্র বিশেষজ্ঞ।
এর কারণ কী, বাংলানিউজের প্রশ্নে খুরশেদ আলম বলেন, মূল কারণ বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার বলে কিছু নেই। বাংলাদেশ মাছ ধরে ছোট ছোট কাঠের নৌকা দিয়ে। এ নৌকাগুলো ২০ থেকে ৩০ মাইলের বেশি গভীর সমুদ্রে যেতে পারে না। কিন্তু, আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চল ২৭০ মাইলেরও বেশি। সে হিসাবে গোটা সমুদ্রদেশটাই পড়ে আছে, যেখানে আমরা পৌঁছাতেই পারছি না।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও গবেষণা থেকে এই সমুদ্র বিশেষজ্ঞ খুরশেদ আলম বলেন, বড় বড়শি দিয়ে এক ধরনের মাছ ধরা হয়। এক লংলাইন ফিশিং বলে। সোর্ড, টুনা, শার্ক এমন কী তিমিও ধরা পড়ে এ ধরনের ফিশিংয়ে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জলসীমায় এ ধরনের মাছ প্রচুর রয়েছে, যা শিকার করে রফতানি করে জিডিপি বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু, সেগুলো ধরার মতো দক্ষ জেলে, শক্ত নৌকা বা জাহাজ এবং যথার্থ প্রযুক্তি ও সামগ্রী কোনোটাই বাংলাদেশের নেই।
কিছুটা আক্ষেপের সুরেই খুরশেদ আলম বলেন, সব কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ার কারণে আমরা বিশ্বে প্রায় সবগুলো উপকূলীয় দেশ থেকে পিছিয়ে গেছি।
কৌশলগত আরো কিছু বিষয় উঠে আসে আলাপচারিতায়।
খুরশেদ আলম বলেন, সমুদ্রের সীমা নির্ধারণে আমাদের প্রয়োজন সমুদ্র অঞ্চল বিষয়টির ওপর আলোকপাত করা। প্রথম ধাপ হলো- ইন্টারনাল ওয়াটার। এ ইন্টারনাল ওয়াটারের পর একটি বেসমেন্ট ধাপ থাকে, সেখান থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত টেরিটরিয়াল অঞ্চল।
এ ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত আকাশে, পানিতে, সমুদ্রে, সমুদ্রের তলে মাটিতে যে সম্পদ রয়েছে, তার ওপর উপকূলীয় দেশটির সার্বভৌমত্ব থাকে। বেসমেন্ট থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একান্ত অথনৈতিক অঞ্চল। এ অঞ্চলে প্রাণী ও অপ্রাণীজ সব বস্তুর ওপর সার্বভৌম অধিকার রয়েছে উপকূলীয় দেশ বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের বিশাল পলি বিধৌত এই অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি মাছ ও সম্পদ পাওয়া যায়। এ জন্যই এ অঞ্চলকে ‘সবচেয়ে মূল্যবান অঞ্চল’ বলে ধরা হয়। অর্থনৈতিক অঞ্চলটি ১৯৫৭ সালের সমুদ্র আইনে ছিল না। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে এটি সংযুক্ত করা হয়। এর পর বেসমেন্ট থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অঞ্চলকে মহীসোপান হিসেবে ধরা হয়, জানালেন খুরশেদ আলম।
তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই সমুদ্রসীমার অধিকার রক্ষার জন্য বাংলাদেশ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যক্রম গ্রহণ করে আসছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে উপমহাদেশের প্রথম ধাপ হিসেবে ‘টেরিটরিয়াল ওয়াটার অ্যান্ড মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট’ শীর্ষক আইন প্রণয়ন করে বাংলাদেশ।
এই আইনের মাধ্যমে ১২ নটিক্যাল মাইল আঞ্চলিক সমুদ্র এলাকা, ১৮ নটিক্যাল মাইল সংলগ্ন সমুদ্র এলাকা এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক এলাকার সঙ্গে কন্টিনেন্টাল মার্জিন পর্যন্ত মহীসোপান এলাকা দাবি করা হয়। প্রতি নটিক্যাল মাইল ১.১৫ মাইলের সমান।
খুরশেদ আলম জানান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভারতসহ এই এলাকা, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকা অঞ্চলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ পৃথক আইন তৈরি করে।
‘আনক্লস’ নামে পরিচিত ‘জাতিসংঘ সমুদ্র আইন কনভেনশন-১৯৮২’ অনুস্বাক্ষরের জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশ ২০ বছরেও আনক্লস অনুস্বাক্ষর করেনি। পরে ২০০১ সালের জুলাই মাসে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশ জাতিসংঘ কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করে। কনভেনশন স্বাক্ষরের ১০ বছরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশকে জাতিসংঘ বরাবরে তাদের দাবি পেশ করা বাধ্যতামূলক করা হয়। সে অনুযায়ী, ২০১১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জাতিসংঘের মহীসোপান সীমা নির্ধারক কমিশনের (সিএলসিএস) কাছে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত দাবি পেশ করে।
এই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলম।
তিনি বলেন, এর আগে ২০০৯ সালে সার্ভে করার জন্য সরকার আমাদের ৮০ কোটি টাকা দেয়।
তবে এই অর্থের অর্ধেকেরও কম ব্যবহার করে কাজটি সম্পন্ন করা হয়।
খুরশেদ আলম বলেন, নেদারল্যান্ডস সরকারের সহায়তায় মাত্র ৩২ কোটি টাকায় ২০১০ সালে আমরা সার্ভে শেষ করতে সমর্থ হই। বাকি টাকা ফেরত দেওয়া হয়।
অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলম আরো বলেন, সমুদ্রের তলদেশে খনিজসহ বিভিন্ন সম্পদরাজি নিয়ে। কথা হয়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশর সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তি, আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের বিভিন্ন বিষয় নিয়েও।
পরবর্তী পর্বে সে বিষয়গুলো আলোকপাত করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৩ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৪