ঢাকা, শনিবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জুন ২০২৪, ২১ জিলহজ ১৪৪৫

শিক্ষা

‘ডেভিলস ব্রেথ’ ব্যবহার করে অপহরণ, জাবির হলে এনে মুক্তিপণ দাবি!

জাবি করেসপডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৩
‘ডেভিলস ব্রেথ’ ব্যবহার করে অপহরণ, জাবির হলে এনে মুক্তিপণ দাবি!

জাবি: রাজধানীর খিলগাঁও থেকে সদরঘাট যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে এক যুবককে ‘ডেভিলস ব্রেথ’ নামের চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগ করে অপহরণ করা হয়। এরপর তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) একটি আবাসিক হলে বন্দী রেখে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়।

এমনই অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে।

পরে ওই যুবককে মারধর করে প্রায় ৫০ হাজার টাকা আদায়ের পর ছেড়ে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ।

বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম বরকত হলের ২১৪/এ কক্ষে এ ঘটনা ঘটে।

ভুক্তভোগী ব্যক্তির নাম ওয়ালিউল্লাহ। তিনি লক্ষীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাঁও এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। রাজধানীর তিতুমীর কলেজ থেকে স্নাতক (সম্মান) পাস করে বর্তমানে চাকরির সন্ধানে আছেন।  

বুধবার রাত সাড়ে বারোটায় সাংবাদিক ও হল প্রশাসনের কাছে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানান ওয়ালিউল্লাহ। এ সময় তিনি ছবি দেখে মারধর ও টাকা আদায়ের সঙ্গে জড়িত একজনকে চিহ্নিত করেন। তার নাম অসিত পাল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫ ব্যাচের বাংলা বিভাগের ছাত্র। এছাড়া শাখা ছাত্রলীগের উপ-পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের শাস্তি ও তার টাকা ফেরত দেওয়ার দাবি জানান ওয়ালিউল্লাহ।

হল প্রশাসনের উপস্থিতিতে ভুক্তভোগী ওয়ালিউল্লাহ বলেন, বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসাবো থেকে সদরঘাটের বাসে উঠেছিলাম। এর পর আমার আর কিছু মনে নেই। পরে কিছুটা জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারি কেউ আমাকে অনুসরণ করতে বলছে। আমিও অনুসরণ করতে থাকি কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারছিলাম না। পরে তারা আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে চারজন ছিলো ও তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলছিল। এসময় তারা আমাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে মারধর করে ও টাকা চায়।

ওয়ালিউল্লাহ দাবি করেন, এসময় অসিতসহ বাকি তিন জন তার কাছে দশ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। এছাড়া ব্যাগে থাকা নগদ চল্লিশ হাজার টাকা ও বিকাশের একটি এজেন্ট নাম্বারে পরিবার থেকে পাঠানো পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে নেয়।

এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সালাম বরকত হলের পাশেই বিকাশ এজেন্ট দোকানটির অবস্থান। দোকানদার আদম আলী বিকাশের মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা আসার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এছাড়া বিকাশে টাকা আদায়ের বিষয়ে সত্যতা মিলেছে বলেও জানায় হল প্রশাসন।

ওয়ালিউল্লাহ বলেন, তারা আমাকে মারধর করে দশ লক্ষ টাকা দাবি করে। আমার শরীরে লোহার পাইপ দিয়ে আঘাত করে ও ছুরি দিয়ে আঘাতের ভয় দেখায়। আমি চাকরি না থাকায় এতো টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ঘাড়ে জোরে আঘাত করে। এসময় আমি তাদের ঘাড় ভেঙে গেছে বললে তারা মারধর বন্ধ করে দেয়। এক পর্যায়ে ঘাড়ে একটি মাফলার পেঁছিয়ে নিচে নামিয়ে হলের বড় গেইট দিয়ে বের করে দেয়।  

ওয়ালিউল্লাহর শরীরে বিভিন্ন ভারি বস্তু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন ও কিছু জায়গায় ছোট ছোট তাজা ক্ষত দেখতে পাওয়া যায়।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহানারা ইমাম হল সংলগ্ন এলাকা থেকে ভুক্তভোগীকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরে ঘটনাটির সম্পর্কে জানাজানি হয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত কয়েকজন সাংবাদিক ও শহীদ সালাম বরকত হল প্রভোস্টের উপস্থিতিতে ঘটনাটির প্রাথমিক তদন্তের কাজ সম্পন্ন করা হয়। এতে ঘটনার প্রাথমিক সত্যতার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানান হলটির প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. সুকল্যাণ কুন্ডু।

প্রাথমিক তদন্তে প্রাধ্যক্ষসহ হলের দায়িত্বরত শিক্ষকরা ওয়ালিউল্লাহর দেওয়া বিবরণের ভিত্তিতে কয়েকটি কক্ষ তল্লাশি করেন। এসময় অসিত পালের কক্ষ (২১৪ নং কক্ষ) থেকে একটি ভাঙা চেয়ার, তার ট্রাংক ও বিভিন্ন মাদকদ্রব্য গ্রহণের কিছু আলামত জব্দ করেন। এছাড়া হল প্রশাসনকে অসিতের কক্ষটি সিলগালা করে দিতে বলেন।

এ সময় ট্রাংকের ভেতর থেকে ওয়ালিউল্লাহর বর্ণনা মতো একটি লোহার পাইপ পাওয়া যায়। এছাড়া ভাঙা চেয়ারটিতে বসিয়ে ওয়ালিউল্লাহকে মারা হয়েছিল বলে ওয়ালিউল্লাহ নিশ্চিত করেন।

ঘটনার বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত অসিত পালের ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।  

উপস্থিত হল ছাত্রলীগের নেতারা জানান, অসিতের অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণের জন্য তাকে তিন-চার মাস আগে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এখন সে হলের বাইরে অবস্থান করছে।

সালাম-বরকত হলের প্রভোস্ট ও ফার্মাসিস্ট অধ্যাপক সুকল্যাণ কুমার কুণ্ডু বলেন, আমার হলে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে তা আমাদের জন্য দুঃখজনক। আমরা তাকে আপাতত মেডিকেল থেকে সিকিউরিটি অফিসে স্থানান্তর করবো। ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।

অধ্যাপক কুণ্ডু আরও বলেন, ভুক্তভোগীকে অচেতন করতে স্কোপোলামিন নামক ড্রাগ ব্যবহার করার সম্ভাবনা বেশি। তার বিবরণ ড্রাগ গ্রহণের পর প্রতিক্রিয়ার সাথে মিলে যায়। এই ড্রাগ প্রয়োগ করা হলে ব্যক্তিকে যা করতে বলা হবে সে তা করবে। তার মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে কাজ করবে না।

এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষার্থী সংগঠনের কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন।  

স্কোপোলামিন নামক ড্রাগের বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তারা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এসকল ড্রাগের বিষয়ে এখন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সচেতন হওয়া দরকার ও নজরদারি বাড়াতে হবে। এই ড্রাগের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়লে চুরি, ছিনতাই, রেপ এর মতো ঘটনাগুলো বাড়বে। এটি আমাদের সচেতন সমাজের জন্য শঙ্কার বিষয়। ’

এ বিষয়ে প্রমাণ সাপেক্ষে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা জানতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী প্রক্টর রনি হোসাইন বলেন, প্রক্টর স্যার ইতোমধ্যে অবহিত হয়েছেন। সাংবাদিকদের মাধ্যমে আমরা ঘটনায় একজনের যুক্ততার প্রমাণ পেয়েছি। বাকি তিনজনকেও খুঁজে বের করতে হবে। তারা কি ক্যাম্পাসের ছাত্র নাকি বাইরের এটাও আমরা ইনভেস্টিগেশন করব। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি হবে। '

প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, প্রভোস্টের বক্তব্যই আমার বক্তব্য। আমরা হল প্রশাসনকে সহযোগিতা করবো।

জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলম বলেন, আমরা একটি গুরুতর অভিযোগ পেয়েছি। সংশ্লিষ্ট হল প্রাধ্যক্ষকে প্রাথমিক তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছি। এ ধরনের অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২৩
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।