ঢাকা: নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি বলেছেন, আগামী এক বছরে বাচ্চাদের মধ্যে যে পরিবর্তন আমরা দেখতে পাবো তা দেখে আমরাই চমকপ্রদ হবো। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের বিরাট একটা মানসিক ভূমিকা লাগবে।
বুধবার (২৯ মার্চ) রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বেলা ১১টায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ বিস্তরণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের প্রশিক্ষণ, এনসিএফ (জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১) মোবাইল অ্যাপ ও সচেতনতামূলক ডিজিটাল কনটেন্টের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ এর বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পাশাপাশি এর বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে অনুষ্ঠানে আলোকপাত করেন শিক্ষামন্ত্রী। এ সময় তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন ডিজিটাল বাংলাদেশ, পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশের সমুদ্রসীমা নির্দিষ্ট করে বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক সম্পদের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি উল্লেখ করে বলেন, এসব উদ্যোগের কোনটিই খুব সহজ ছিল না। প্রতিটি উদ্যোগের বিরুদ্ধেই কিছু মানুষ ষড়যন্ত্র করেছে। যে কোনো প্রকারে উন্নয়নকে থামিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও নেতৃত্বে সব বাধা অতিক্রম করে সরকার এসব উদ্যোগকে বাস্তবে রূপায়িত করেছে। ঠিক একইভাবে সরকার যখন জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কিছু মানুষ শুরু থেকেই এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র করে এ উদ্যোগকে দমানো যাবে না।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, করোনার মতো অতিমারি আর বিশ্ব রাজনীতির জটিল পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠিত সব ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দিচ্ছে। টিকে থাকার প্রয়োজনে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই তাই বর্তমানে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনছে। আমরাও যদি উন্নত দেশে পরিণত হতে চাই, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদেরও পুরানো ব্যবস্থা আঁকড়ে ধরে বসে থাকলে চলবে না। কাজেই আমরা চাই বা না চাই, শিক্ষা ব্যবস্থায় এ পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা এখন হাতে কলমে প্রয়োগ করতে পারার পারদর্শিতা অর্জন করবে। কাজেই পারদর্শিতা পরিমাপের জন্য আগের মতো শুধু খাতা-কলমের পরীক্ষা পদ্ধতিতেও এখন চলছে না। ফলে পরীক্ষা পদ্ধতিতেও আসছে ব্যাপক পরিবর্তন। নতুন পদ্ধতিতে শ্রেণি কক্ষে বা শ্রেণি কক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীরা যখনই শিখবে তখনই তার মূল্যায়ন করা হবে। এছাড়াও বছরে দুইবার তাদের সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। অবশ্যই এটা একটা বড় ধরনের পরিবর্তন। প্রচলিত পদ্ধতিতে যেখানে শিক্ষার্থীরা বেশি নম্বর পাবার প্রতিযোগিতায় অভ্যন্ত সেখানে হঠাৎ করেই এখন নম্বরের বদলে শেখার প্রতিযোগিতা শুরু হতে যাচ্ছে। যদি এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে আগামী প্রজন্ম অনেক যোগ্যতা সম্পন্ন হয়ে বড় হবে। তাদের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটবে।
তার মতে, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। শিক্ষক- শিক্ষার্থী- অভিভাবকসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে নিজ নিজ ভূমিকা যথাযথভাবে পালনের উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি মনে করেন এক্ষেত্রে শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানরা জাতীয় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে তাদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা উপলব্ধি করবেন। এলাকায় ফিরে গিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠুভাবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মনোযোগী হবেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো: কামাল হোসেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান, ইউনিসেফের চিফ অব এডুকেশন দীপা শংকর।
উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ প্রচলিত মুখস্ত নির্ভর শিক্ষার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের মাঝে সূক্ষ চিন্তন দক্ষতা, সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, উদ্ভাবন দক্ষতা, সহমর্মিতাসহ আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু দক্ষতা তৈরি করবে। আর এর সবই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে তাদের যোগ্য করে তুলবে। এর মাধ্যমে আমাদের আগামী প্রজন্ম কীভাবে শিখতে হয় সে দক্ষতা অর্জন করে জীবনব্যাপী শিখনের যোগ্যতা অর্জন করবে। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন যুগের চাহিদা মেটানোর মতো জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে। নতুন শিক্ষাক্রমের সুফল পেতে হলে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, ভবিষ্যতের যে পরিবর্তনগুলো আসছে প্রযুক্তিতে বিজ্ঞানে সর্বক্ষেত্রে, সেখানে আমাদের এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীদেরকে প্রস্তুত করতে হবে। সেটার জন্য এবং সেটা করার জন্য যে গতানুগতিক সনাতন পদ্ধতিতে আমরা যে পাঠদান করছি সেটা যথেষ্ট নয়। জিপিএ'র মাধ্যমে এখন একটা শিক্ষার্থী জিপিএ মানে বোঝে না, কিন্তু সে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। এগুলো কেন হচ্ছে, এগুলো হচ্ছে কারণ স্মরণশক্তির ওপর নির্ভরতার কারণে। মেরিট মানে মেমোরি না। শিক্ষার্থীর মধ্যে ভাবার যে চিন্তাধারা, সেটি তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীকে চিন্তাশীল করে তুলতে হবে।
অনুষ্ঠানে এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক।
আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ।
অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ (এনসিটিবি) এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা (মাউশি)।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২৩
এইচএমএস/জেএইচ