ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন, ঢাবির সফটওয়্যারগুলোর কোনো কাজ নেই  

ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০২৩
ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন, ঢাবির সফটওয়্যারগুলোর কোনো কাজ নেই  

ঢাবি করেসপন্ডেন্ট: চলতি বছর ১৪ জুন ঢাকঢোল পিটিয়ে জাঁকজমকে ‘ডিইউবিডিএলএমএস’ নামে একটি লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সফটওয়্যার উদ্বোধন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।  

উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের উপস্থিতিতে উদ্‌বোধনী অনুষ্ঠানে বলা হয়েছিল, এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ক্লাস, কোর্সসমূহ ও পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা অটোমেশনের আওতায় আনা হবে এবং একাডেমিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।

 

তবে জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনেই সফটওয়্যারটির সমাপ্তি ঘটেছে, আর কাজ হয়নি কিছুই। সফটওয়্যারটির বর্তমান কী অবস্থা, তার ব্যাপারেও ঠিকঠাক জানেন না কেউই।  

একই অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরিকৃত কয়েকটি সফটওয়্যারের।  

ডিউবিডিএলএমএস সফটওয়্যারটি তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের পরিচালক অধ্যাপক আসিফ হোসেন খান।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা যে সফটওয়্যারটি তৈরি করেছি তা এখনো ব্যবহার হচ্ছে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও চারুকলাসহ এমন কিছু অনুষদ আছে যাদের একাডেমিক কারণেই খুব বেশি প্রযুক্তির জ্ঞান নেই। বাইরের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সগুলো উন্মুক্তভাবে বাছাইয়ের সুযোগ থাকায় এলএমএস তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু আমাদের এখানে নির্ধারিত কোর্স পদ্ধতির কারণে এলএমএস অত দরকার হয় না। তবুও একাডেমিক স্বচ্ছতা তৈরি করতে আমরা এটা তৈরি করেছিলাম।

এটি কবে নাগাদ চালু হবে জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বিভাগগুলো এগিয়ে এলেই এটি চালু করা যাবে। তাদের কোর্সসহ আনুষঙ্গিক তথ্য আমরা অন্তর্ভুক্ত করে দেব। তবে এখনো কোনো বিভাগ এগিয়ে আসেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন সূত্রে জানা যায়, বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন এলএমএস প্রতিষ্ঠান থেকে হার্ভার্ড, ইয়েল, ক্যালিফোর্নিয়া, স্ট্যামফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাবস্ক্রিপশন নিয়ে এলএমএস ব্যবহার করে থাকে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজের উদ্যোগেই এলএমএস সফটওয়্যারটি তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি বিশেষজ্ঞদের মতে, সফটওয়্যারটি তৈরির সময় যথার্থ পরিকল্পনা করা হয়নি। সাধারণত একটি এলএমএস সফটওয়্যারে যে ধরনের কম্পোনেন্ট (উপাদান) থাকে, এতে সেসব ছিল না।  

প্লেজিয়ারিজম সফটওয়্যারেরও কার্যক্রম নেই, বাংলা গবেষণা যাচাই হয় না 

একই অবস্থা গবেষণায় প্লেজিয়ারিজম শনাক্তে নির্মিত ডিইউবিডি২১ সফটওয়্যারের। এটিরও কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। গত বছরের ২ আগস্ট সফটওয়্যারটি উদ্বোধন করা হয়। উদ্‌বোধনী অনুষ্ঠানে বলা হয়েছিল, বাংলায় থিসিস, জার্নাল, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, অ্যাসাইনমেন্টসহ সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রের প্লেজিয়ারিজম যাচাইয়ে এটি মাইলফলক হবে। তবে পর্যাপ্ত ডেটা (তথ্য) ইনপুট করতে না পারায় এটি এখনও ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠেনি।  

এদিকে বাংলা প্লেজিয়ারিজম শনাক্তকরণ সফটওয়্যার না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা গবেষণা ও প্রকাশনাগুলো প্লেজিয়ারিজম নিরীক্ষণের বাইরে থেকে যাচ্ছে। চলতি বছরের ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ জন গবেষককে পিএইচডি ও ১৫ জনকে এমফিল ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছিল। তারমধ্যে অন্তত নয়জনের গবেষণা ও থিসিস ছিল বাংলায়, কোনোটিই প্লেজিয়ারিজম নিরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।  

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করা খুব বেশি সময়ের ব্যাপার নয়। তবে তাকে তথ্য দিয়ে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া, প্লেজিয়ারিজম শনাক্তের মতো একটি বিষয়, যেখানে বাংলা ভাষায় সকল ডেটা ইনপুট করা না গেলে সিমিলারিটি (সামঞ্জস্য বা চুরি) নির্ণয় করা সম্ভব হবে না। ফলে এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আরও জটিল ও সময়সাপেক্ষ। একইসঙ্গে তথ্য ব্যবহারের সুবিধা পেতে হলে একটি মোটা অংকের অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারও এর সঙ্গে জড়িত। তবে এসব না করেই এই সফটওয়্যারটি উদ্বোধন করা হয়েছে। ’ 

সফটওয়্যারটি তৈরিতে নেতৃত্বে দিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার।  

তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল, এমফিল, পিএইচডিসহ বাংলা গবেষণাপত্রের প্লেজিয়ারিজম শনাক্ত করার জন্য এটি করা হয়েছে। তবে এখনও অনেক কাজ বাকি। আমরা চারদিক থেকে এখানে ডেটা (তথ্য) দিচ্ছি। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন তথ্য রয়েছে, আলোচনা করে তথ্যের ব্যাপারে মধ্যস্ততায় আসতে হয়। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ’ 

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্লেজিয়ারিজম শনাক্তকরণ দায়িত্বে নিয়োজিত উপ-গ্রন্থাগারিক আনিসুর রহমান বলেন, ‘এটি যখন উদ্বোধন হয়, তখন আমাদেরকেও ডাকা হয়েছিল। তবে পরে এটি কী অবস্থায় আছে জানি না। সফটওয়্যারটি তৈরি হয়েছে তবে এখানে তথ্যের অভাব আছে। ’ 

আনিসুর রহমান জানান, প্লেজিয়ারিজম শনাক্তে তারা গ্রন্থাগারে আইথেনটিকেট এন্টি প্লেজিয়ারিজম টুল ব্যবহার করেন। তবে সেখানে বাংলা সাপোর্ট করে না বিধায় শুধু ইংরেজিগুলোই প্লেজিয়ারিজম চেক করা হয়।  

তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে যে গবেষণাপত্রগুলো আসে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাগুলো আমরা চেক করতে পারি না। ড্রিলবিট প্লেজিয়ারিজম নামে বাংলা ভাষার প্লেজিয়ারিজম শনাক্তে ভারতের একটি টুল আছে, তবে বাংলাদেশে এখনো অনুমোদন না দেওয়ায় আমরা ব্যবহার করতে পারি না। ’ 

ব্রেইল সফটওয়্যারেরও কার্যক্রম নেই 

ব্যতিক্রম নয় ব্রেইল থেকে বাংলা টেক্সট রূপান্তরকারী সফটওয়্যারের অবস্থাও। ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এই সফটওয়্যারটি উদ্বোধন করে। ব্রেইল হলো ছয়টি বিন্দুর সমন্বয়ে দৃষ্টিহীনদের লেখার একটি পদ্ধতি। দৃষ্টিহীন ব্যক্তিরা এই ছয়টি বিন্দুর নকশা অনুযায়ী লেখেন এবং হাত বুলিয়ে অর্থ বুঝতে পারেন।  

তখন গবেষণা দলের সদস্য তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদুল কবির বলেছিলেন, সফটওয়্যারটি ব্রেইল লেখা বাংলা ভাষার লেখায় রূপান্তর করবে। ফলে সবাই সেটি বুঝতে পারবে। এটি পুরোপুরি চালু হলে দৃষ্টিহীনদের আর শ্রুতিলেখক লাগবে না।  

জানতে চাইলে আহমেদুল কবির বাংলানিউজকে বলেন, ‘ব্রেইল পদ্ধতিতে সফটওয়্যারটির কাজ চলমান রয়েছে। আমরা এটা আপডেট করার চেষ্টা করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাথে সংযুক্ত হয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতিতে পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করছি। এটি খুবই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ’ 

আইটি বিশেষজ্ঞ সাইদ মাহমুদ সোহরাব বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বের প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযোগ খুব বেশি নেই। প্রযুক্তিগত দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীতে অনেকদূর পিছিয়ে আছে। ’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের ডিএলএমএস তৈরি হয়ে গেছে। আমরা চাইলে এটিকে ব্যবহার করতে পারি। আর ডিইউবিডি২১ নামে যে বাংলা প্লেজিয়ারিজম শনাক্তকরণ সফটওয়্যার সেটির ব্যাপারে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। বাংলার যেসকল রেফুজিটরি (সংগ্রহস্থল) আছে, সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ না পেলে আমরা সফটওয়্যারটি দিয়ে শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব না।  যত বেশি সংগ্রহস্থলের সঙ্গে আমাদের সফটওয়্যারের যোগাযোগ থাকবে এটা ততো শক্তিশালী হবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলা একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশনা থেকেও আমরা একটি বড় অংশের তথ্য সংগ্রহ করতে পারি। ’

বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০২৩
এসএএইচ


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।