ইবি: ‘গতরাতে (৭ ফেব্রুয়ারি) নাকে আমাকে খত দেওয়া হয়েছিল। রড দিয়ে মারা হয়েছিল।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি ১৩৬ নং কক্ষে (গণরুমে) অনুষ্ঠিত সমঝোতা বৈঠকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) লালন শাহ হলে র্যাগিংয়ের বিবরণ দিলেন নিপীড়িত শিক্ষার্থীরা।
অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগীদের নিয়ে এ সমঝোতা বৈঠক করেন লালন শাহ হলের গণরুমের দায়িত্বে থাকা ‘বড় ভাই’ নাসিম আহমেদ মাসুম।
মাসুম অর্থনীতি বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি শৈলকূপায়। মাসুম শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।
বিবস্ত্র করে র্যাগিংয়ের ঘটনা যেন জানাজানি না হয় সেজন্য কয়েক দফায় বৈঠক করেছিলেন হলের কয়েকজন ‘বড় ভাই’। এতে অন্তত ২০ জন উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের একটি অডিও বাংলানিউজের হাতে এসেছে। সেখানে নির্যাতনের ভয়াবহতার চিত্রটি ফুটে ওঠেছে। বাইরে যেন জানাজানি না হয় সেজন্য হুমকি-ধাকমি দিতেও দেখা গেছে বড় ভাইকে।
অডিওতে মাসুমের কাছে ভুক্তভোগী নির্যাতনের ভয়াবহতা প্রকাশ করলেও উল্টো হুমকি-ধামকি ও মানসিক হেনস্থার শিকার হন। অডিওত ভুক্তভোগী উলঙ্গ করে অশ্লীল ভিডিও দেখানোর কথা বলায় পাল্টা মাসুমকে বলতে শোনা যায়, ‘তুই পুরুষ মানুষ না! ছাড়ছে তো কি হইছে?’ এছাড়াও ভুক্তভোগী তার নির্যাতনের বর্ণনা দিলে মাসুমসহ সকলে মিলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অশ্লীল গালিগালাজ, গোপনাঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা বলেন ও হাসাহাসি করেন।
সংবাদ মাধ্যামে সেই কথোপকথন পাঠপোযোগী ও প্রকাশযোগ্য নয়।
অডিওতে মাসুমকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘আমার রুমে গেলি। আমাকে কিছু বলিসনি। তোর কী বলা উচিত ছিল না? হল চালাই আমি দায়ভার আমার। নিউজ হলি তো আমার নামে হইতো। আমাকে জানাইসনি তোর জেলা কল্যাণের ভাইকে জানাইসিস। তাইলে কথাটা বাইরে গেলো কী করতি? তোরে হলে তুলেছে একজন। দায়ভার আরেকজনের। বিচার দিতে যাস আরেক ভাইয়ের কাছে। সেই ভাই তো তোরে প্রক্টরের কাছে নিয়ে গেছে। ’
জানা গেছে, মিটমাট করার উদ্দেশ্যে ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তদের নিয়ে ১৩৬ নং কক্ষেই বসেন হলের কয়েকজন ‘বড় ভাই’। অডিও এবং গণরুমে থাকা ছাত্রদের থেকে জানা যায়, বড় ভাই মাসুম সকলের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা জানতে চান।
এসময় মাসুম জুনিয়রদের বলেন, পরিচয় হসনি! এই জায়গায় কয়টা সিনিয়রকে চিনিস। এখানে সবার নাম বল?
এক জুনিয়র হেসে উঠলে ধমক দিয়ে মাসুম বলেন, কতদিন রুমে থাকিস এদেরকে চিনিস না? অনেকক্ষণ দাঁড়া করাই রাখছে তাই বলে হেনস্তা হয়ে গেল?
মাসুম বলেন, তোর আগেও নাকি ২-৩ বার এরকম হইছে। তোর সাথেই কেন এমন হইছে। আর কারো সাথে তো হয়নি। তোর কোনো দোষ নাই?
একপর্যায়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে নির্যাতনে অভিযুক্তরা বলেন, ও কথায় কথায় হাসে এজন্য মারছি। এরপর মাসুম গালি দিয়ে অভিযুক্তদের বলেন, ও হাসাহাসি করুক আর যাই করুক সেজন্য তোরা মারবি? প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দেওয়া হলে যে কয়েকজনের নাম আছে সে কয়েকজনই বহিষ্কার হতো। যদি আমার নাম আসতো, আমি ডিরেক্ট বলে দিতাম, আমি জানি না কিছু। কারণ, এ জায়গায় আমি উপস্থিত ছিলাম না। এ বিষয় নিয়ে যেন আর কোন কথা না হয়, এসব বাইরে যাবে না।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগ কর্মী নাসিম আহমেদ মাসুমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি হল চালানোর কেউ না। হল চালায় প্রশাসন। আর র্যাগিংয়ের যে ব্যাপারটা, তেমন কিছুই না। সিনিয়র-জুনিয়রদের মাঝে ঝামেলা হয়েছিল। ওরাই মিউচুয়াল করেছে। আমি শুধু এমনিই উপস্থিত ছিলাম। ’
এদিকে নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে ভুক্তভোগীকে নানাভাবে চাপ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাখা ছাত্রলীগের এক কর্মী জানান, ঘটনার পরদিন দুপুরে ফুটবল মাঠে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর কাছে অভিযুক্তদের নিয়ে আসেন শাখা ছাত্রলীগ কর্মী মেহেদী হাসান হাফিজ ও নাসিম আহমেদ মাসুম। এসময় অভিযুক্তদের চড়-থাপ্পড় মারেন হাফিজ। এছাড়াও তার নির্দেশে ভুক্তভোগীর কাছে ক্ষমা চান অভিযুক্তরা।
জানা গেছে, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অনবরত হুমকি ও চাপের কারণে এ ঘটনায় কোনো অভিযোগ নেই বলে মঙ্গলবার লালন শাহ হল প্রভোস্টের কাছে লিখিত দেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। তবে এ ঘটনার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে হল প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পৃথক দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
র্যাগিংয়ে অভিযুক্তরা হলেন- শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মুদাচ্ছির খান কাফি এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সাগরসহ অন্তত ৫ জন। এদিকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের উজ্জ্বল হোসাইন ও ল’ অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ইউসুফ সানী নামে দুই শিক্ষার্থী ছিল বলে জানা গেছে। উভয়ই ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয় বলেন, আমরা অভিযুক্তের পক্ষ নিইনি। ভুক্তভোগী যেন ন্যায়বিচার পায় এজন্য আমরা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছি।
সামগ্রিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদাৎ হোসেন আজাদ বলেন, ‘র্যাগিং নিয়ে আমরা শক্ত অবস্থানে আছি। তদারকির কোনো ঘাটতি নেই। প্রশাসনে কেনো ধরনের গাফিলতিও নেই। ঘটনা জানার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
উল্লেখ্য, গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলের গণরুমে এক শিক্ষার্থীকে রাতভর র্যাগিং, নগ্ন করে রড দিয়ে মারধর, পর্নগ্রাফি দেখানো ও টেবিলের ওপর কাকতাড়ুয়া বানিয়ে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।
শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিষয়টি ঘরোয়াভাবে সমাধান করায় এবং ‘বিশেষ চাপে’ প্রশাসনের কাছে কোনো অভিযোগ করেননি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। শুধু সেই দিনই নয়। একই কক্ষে প্রায়শই র্যাগিং হয় বলে হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৪
এসএএইচ