ঢাবি: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কু-রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
শুক্রবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি আয়োজিত আয়োজিত ‘বাংলাদেশে শিক্ষক রাজনীতি : উচ্চশিক্ষায় অর্জন, সংকট ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন ।
তিনি বলেন, “আগে শিক্ষকরা আন্দোলন করতেন দেশের জন্য কিংবা কোনো অধিকার আদায়ের জন্য। তখন এটাকে ছাত্র-শিক্ষক আন্দোলন বলা হতো। কিন্তু এখন বলা হয়, ছাত্র রাজনীতি বা শিক্ষক রাজনীতি। এটা মূলত রাজনীতি নয়, কু-রাজনীতি। ”
মন্ত্রী বলেন, “৭৩ এর অধ্যাদেশ পরিবর্তন, সংশোধন ও পরিমার্জনে বর্তমান সরকারের কোনো বাধা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি সম্মিলিতভাবে এর পরিবর্তনের দাবি জানায় ও নতুন কোনো রূপরেখা প্রস্তুত করে দেয় তবে অবশ্যই এর পরিবর্তন হতে পারে। এজন্য শিক্ষকরা আলোচনায় বসতে পারেন, এসব আলোচনায় কোনো বাধা নেই। ”
তিনি বলেন, “৭৩ এর অধ্যাদেশ প্রণয়নের সময় অনেক আলোচনা-গবেষণা হয়েছে। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকতে পারবে না। এ অধ্যাদেশ যদি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সহায়ক না হয়, তবে অবশ্যই তা সংশোধন করা হবে। ”
মন্ত্রী শিক্ষক রাজনীতির সংকট নিরসনের জন্য সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করবে বলে আশ্বাস দিয়ে বলেন, “আপনারা শিক্ষকরা আলোচনায় বসুন। সরকারের পক্ষ থেকে আমি সহায়তা করবো। ”
তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা জাতীয় কোনো স্বার্থে এক হতে পারি না। ৬২ বছর আগে যে জাতি ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছে, সে জাতির অর্ধেক মানুষ এখনো মাতৃভাষার অক্ষরের সঙ্গে পরিচিত নয়। এর চাইতে দুর্ভাগ্যের আর কি হতে পারে!”
নাহিদ বলেন, “কোনো একটি বিষয়ে রাজনৈতিক ভিন্নমত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। না হলে নতুন নতুন চিন্তা, নতুন জ্ঞান ও উন্নত কোনো কিছু বের হয়ে আসবে না। ”
মন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর্থিকভাবে নিজেদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমাদের দেশের মত সস্তা উচ্চশিক্ষা বিশ্বের আর কোথাও নেই। তবে এখানকার শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা অনেক কম। নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হলে দায়িত্বশীল স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। ”
তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা সবসময় মনে রাখতে হবে। তারা পড়াশোনা করছেন জনগণের কষ্টের টাকায়। একজন ভিক্ষুকের কাছেও তারা দায়বদ্ধ। একথা মনে রাখলে তারা জাতিকে অনেক কিছু দিতে পারবেন। ”
তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিটকে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে শিক্ষকদের কাজ করতে হবে। আপনারা (শিক্ষক) কেবল সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি জানান, কিন্তু নিজেরা কিছু করেন না। কিভাবে উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়ন করা যায়, সে বিষয়ে একটি প্রস্তাব নিয়ে আসুন, আমরা সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। ”
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গণতন্ত্রহীন প্রতিষ্ঠান, যা অবশ্যই সরকারের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ”
তিনি আরও বলেন, শিক্ষক রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য আছে। শিক্ষককের রাজনীতি চেতনার ও নৈতিক অবস্থানের এবং যার ধারাবাহিকতার সক্রিয় কর্মকাণ্ডেরও। কিন্তু এমন রাজনীতি অন্ধ দলবাজির রাজনীতি হতে পারে না । কারণ শিক্ষকতার নৈতিক দিকটির কথা বদ দিলেও দলীয়ভাবে চিহ্নিত শিক্ষক শিক্ষার্থীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারান। জানান্তিকে শ্রুত, শিক্ষার্থীদের কাছে আমাদের পরিচিতি নাকি ‘ব্লু স্যার/ব্লু ম্যাডাম অথবা ‘হোয়াইট স্যার/ হোয়াইট ম্যাডাম’ হিসেবে, যা আসলে আমাদের পেশাগত পরিচয়কে ক্ষুন্ন করে। ”
তিনি বলেন, “শিক্ষক রাজনীতিতে শিক্ষক বা রাজনীতি কোনোটিই নেই, যা আছে ফন্দি ফিকির। ”
সেমিনারের আলোচক আবুল কাশেস ফজলুল হক বলেন, “প্রতিটি সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে একটা নিজেস্ব পদ্ধতি অবলম্বন করে। যার দ্বারা তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে। ”
তাদের এই নিজেস্ব পদ্ধতিই বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করে দিচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সেমিনারের আরেক আলোচক বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ মকসুদ বলেন, “সমগ্র দেশের মানুষের যে নৈতিক পতন সেখানে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো থাকবে তা তো হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা অবশ্যই সংকটেরমধ্যে রয়েছে। ”
তিনি বলেন, “শিক্ষক রাজনীতির অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। রাজনীতি তো দোষের কিছু না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররা যদি রাজনীতি করতে পারেন তবে শিক্ষকরা রাজনীতির বাইরে থাকবেন তা কি হয়। তাঁরা তো নতুন নতুন রাজনৈতিক তত্ত্বের জন্ম দেবেন। সেসব তত্ত্বের প্রয়োগে বদলে যাবে দেশ। এমনটাই প্রত্যাশা ও স্বপ্ন দেশের মানুষের। ”
উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দীক বলেন, “রাজনীতি দেশের কল্যাণে, সত্য ও বস্তু নিষ্ঠ রাজনীতি আমাদের সবার কাম্য। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এত শিক্ষকরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে তাদের বিজয়ের আগ মুহূর্তে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মাহবুব রনির সভাপতিত্বে সেমিনারে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক মামুন আহমেদ, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রাকিবউদ্দীন আহমেদ, ঢাবি সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাকিব আহমেদ, ফিল্ম ও টেলিভিশন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান এ জে এম শফিউল আলম ভূইয়া প্রমুখ।
সেমিনারে ঢাবি সাংবাদিক সমিতির ত্রৈমাসিক ‘প্রস্তাব’র বিশেষ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন ও সাংবাদিক সমিতির নিজেস্ব ওয়েব www.dujabd.org সাইট এর উদ্বোধন করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৩
এমএইচ/সম্পাদনা: আবু হাসান শাহীন, নিউজরুম এডিটর