ময়মনসিংহ: দেশের সেশন জ্যামবিহীন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)।
‘প্রকৃতিকন্যা’ খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাসকে রক্তে লাল করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ, যার অপকর্মে অনির্দিষ্টকালের বন্ধের ফাঁদে পড়েছে দেশের কৃষিশিক্ষার অন্যতম এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
শনিবার কেন্দ্র থেকে বাকৃবি ছাত্রলীগের ১০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে বাকৃবি ছাত্রলীগকে আপাতত ঠাণ্ডা করা হয়েছে। অবসান হয়েছে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এ সংগঠনটির আজাদ-ইমনের ঘটনাবহুল ২১ মাসের অধ্যায়।
শনিবার বাকৃবি ছাত্রলীগের সভাপতি শামসুদ্দিন আল আজাদ ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামান ইমনকে বহিষ্কার করা হয়।
নিষ্পাপ ১০ বছর বয়েসী শিশু রাব্বির প্রাণহানির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে আজাদ ও ইমনের রাজত্ব।
বাকৃবি ছাত্রলীগের ২১ মাসের আলোচিত বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের সার সংক্ষেপ তুলে ধরা হচ্ছে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য।
১৬ এপ্রিল ২০১১:
২০১১ সালের ১৬ এপ্রিল কেন্দ্র থেকে বাকৃবি ছাত্রলীগের ১০১ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুদ্দিন আল আজাদ ও রফিকুজ্জামান ইমন।
৭ আগস্ট ২০১১:
ছিনতাই ঘটনায় দুইছাত্রকে গ্রেফতারের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের একাংশ প্রক্টর আবু হাদী নূর আলী খানের গাড়িতে হামলা চালায় এবং ক্যাম্পাসের শিক্ষক কোয়ার্টারে তার বাসায় গিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে।
৮ আগস্ট ২০১১:
ছিনতাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক বাকবিতণ্ডা, ধস্তাধস্তি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগের হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ২০ শিক্ষক আহত হন।
ওই সময় বাকৃবি ছাত্রলীগের সভাপতি শামসুদ্দিন আল আজাদ ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামান ইমন স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “শিক্ষকদের উগ্রতার কারণে আজকের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষকরা ক্ষিপ্ত হয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে মারধরও করেছেন। ”
৯ আগস্ট ২০১১:
ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জরুরি সভা করে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করেন। ধারণ করেন কালো ব্যাজ।
৯ আগস্ট ২০১১:
এঘটনার পর সংবাদ সম্মেলন করে বাকৃবি ছাত্রলীগ। সংবাদ সম্মেলনে ছিনতাই, প্রক্টরের বাসায় হামলা ও শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনো সম্পৃকতা নেই বলে দাবি করা হয়।
সেই সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামান ইমন তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, “আওয়ামী লীগপন্থি প্রক্টর আবু হাদী নূর আলী খানের নেতৃত্বে ২০ থেকে ২৫ জন বিএনপি ও জামায়াতপন্থি সন্ত্রাসীরা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে বেধড়ক মারধর করে টেনে-হিঁচড়ে পুলিশে সোপর্দ করেন।
বাকৃবি ছাত্রলীগ উদ্ভুত সব ঘটনার তদন্তসাপেক্ষে জড়িত সব ছাত্র-শিক্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছে। ”
১১ আগস্ট ২০১১:
বাকৃবিতে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। এ সময় বাকৃবি ছাত্রলীগের নেতারা তার সঙ্গে বৈঠকে নিজেদের বদলানোর অঙ্গীকার করেন।
১৪ আগস্ট ২০১১:
তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাকৃবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ৫ নেতাকে নির্দয়ভাবে মারধর করে।
১৩ মে, ২০১২:
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বীনা) গোপালগঞ্জের উপকেন্দ্র নির্মাণের টেন্ডারে অংশ নিতে বাকৃবি ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি আব্দুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মারধরের শিকার হন।
ওই সময় তিনি অভিযোগ করেন, “৫ লাখ টাকা চাঁদা না দেওয়ায় তার ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটে। ”
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি শামসুদ্দিন আল আজাদ ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামান ইমনকে আসামি করে সাবেক ভিপি আব্দুস সালাম একটি মামলা দায়ের করেন।
৬ জুন, ২০১২:
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কামাল রণজিৎ মার্কেটে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী হারেছের দোকান থেকে ছাত্রলীগের এক নেতা চা-সিগারেট নিয়ে টাকা না দেওয়ার প্রতিবাদ করায় ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন হারেছের ছেলে রতন। ভাঙচুর করা হয়, হারেছের চা দোকান। এ নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ।
১২ জুন, ২০১২:
স্থানীয় এলাকাবাসীর দুদফা দাবি পূরণ না হওয়ায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে বাকৃবি ছাত্রলীগ নিজেদের ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাঙচুর করে।
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের জব্বারের মোড় এলাকায় উপড়ে ফেলে রেল লাইন। এর ফলে, প্রায় ৪ ঘণ্টা বন্ধ থাকে ময়মনসিংহ-ঢাকা রেল যোগাযোগ।
১৬ জানুয়ারি ২০১৩:
বাকৃবি ছাত্রলীগের সভাপতি শামসুদ্দিন আল আজাদ গ্রুপের বঙ্গবন্ধু হলের কিছু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামান ইমন নিয়ন্ত্রিত ঈশা খাঁ হলের কিছু ছাত্রের পূর্ব শত্রুতার মীমাংসা করতে ক্যাম্পাসের কামাল-রঞ্জিত মার্কেটে ডাকলে সমঝোতার বদলে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
এ সময় সভাপতি গ্রুপের নেতাকর্মীরা লাঠি দিয়ে সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের মুফরাত, স্নেহাশীষ, তুহিন, মাসুদ, জোবায়ের ও নয়নসহ ১০ জনকে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে।
এ খবর সাধারণ সম্পাদক নিয়ন্ত্রিত অন্য ৫টি হলে ছড়িয়ে পড়লে ওই হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ঈশা খাঁ হলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সভাপতি নিয়ন্ত্রিত রেললাইনের অপর পাশের ৩টি হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া করে।
১৭ জানুয়ারি ২০১৩:
পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ১৭ জানুয়ারি দুপক্ষের মধ্যে ফের সংঘর্ষ বাঁধে। এ সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ৫ নেতাকর্মী আহত হয়।
১৮ জানুয়ারি ২০১৩:
পূর্ব শত্রুতার জের হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়। এ সময় উভয় পক্ষের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জব্বার মোড়ের বেশ কয়েকটি দোকানপাট ভাঙচুর করে এবং ১২ রাউন্ড গুলি বিনিময় হয়।
১৯ জানুয়ারি ২০১৩:
১৮ জানুয়ারির জের ধরে দুপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের জব্বার মোড়ে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। ছাত্রলীগের দুই নেতা গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ হয় নিরীহ ১০ বছর বয়েসী রাব্বি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে সে মারা যায়।
এর পর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি সংগঠন বিরোধী কার্যকলাপের দায়ে বাকৃবি ছাত্রলীগের সভাপতি শামসুদ্দিন আল আজাদ ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামান ইমনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে। বিলুপ্ত করা হয়, বাকৃবি ছাত্রলীগের ১০১ সদস্যের কমিটি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৩
মামুন খান/সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর