ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: অনুষ্ঠানের নাম ‘নেলসন ম্যান্ডেলা স্মরণসভা’। অনুষ্ঠানে বক্তারা বক্তব্য শেষ করছেন আর উপস্থাপক দর্শকদের অনুরোধ করছেন করতালি দিতে! অমনি ‘ভাড়াটে দর্শক’ করতালি দিয়ে সেমিনার কক্ষ ফাটিয়ে দিচ্ছে, সাথে দুয়োধ্বনি দিতেও ভুলছে না!’
বক্তা হিসেবে একজনের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে, অথচ তিনি মঞ্চে বসে দিব্যি ঘুমোচ্ছেন! তাকে ডেকে তুলে পাঠাতে হচ্ছে বক্তব্য দিতে।
বেশিরভাগ বক্তাকেই নেলসন ম্যান্ডেলা নামটি উচ্চারণ করতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। এ অবস্থা দেখে পাশে বসা এক সাংবাদিক বলেই বসলেন, ‘ভাই এদের জিজ্ঞাসা করেন তো নেলসন ম্যান্ডেলার নাম এরা আগে কেউ শুনেছে কিনা!’ শনিবার বিকেলে কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির ভিআইপি সেমিনার হলে ‘অহিংস দর্শনের প্রতীক ম্যান্ডেলা’ শীর্ষক ইতিহাসের মহানায়ক নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে তেমনি এক ‘স্মরণসভা’র আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের আয়োজক হিসেবে নাম লেখা ছিল ‘নেলসন ম্যান্ডেলা স্মৃতি সংসদ’, ‘বাংলাদেশ শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ, এবং ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মাওলা ফাউন্ডেশন’ ---তিনটি সংগঠনের নাম। তিনটি সংগঠনেরই প্রধান আবার গোলাম রাব্বানী নামের এক ব্যক্তি। তিনি আবার ‘ওয়ার্ল্ড হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল’ নামের একটি সংগঠনেরও সাধারণ সম্পাদক!
স্মরণসভায় উপস্থিতদের বেশিরভাগেরই অভিব্যক্তি দেখে কৌতূহল হলো, এরা আগে থেকেই ম্যান্ডেলার নামের সাথে পরিচিত কিনা। এই কৌতূহল থেকেই এই প্রতিবেদক এদের একজনের সাথে কথা বলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ‘শ্রোতা-দর্শক’ বাংলানিউজকে বললেন, ‘আমি রাজমিস্ত্রির যোগালির কাজ করি। বিকেলে কোনো কাজকাম আছিল না। এই অনুষ্ঠানের লোক গিয়া আমারে ও আমাদের প্রায় ২০ জনরে ভাড়া কইরা নিয়া আইছে। ’
‘কতো টাকা করে দিয়েছে এবং কে ভাড়া করেছে?’ --জানতে চাইলে তিনি তা বলতে আর রাজি হলেন না। বাকী দর্শকরা ছিলেন আয়োজকদের বাবা, মা, ভাই-বোনসহ পরিবার-পরিজন এবং আত্মীয় স্বজন। বিভিন্ন ইস্যুকে পুঁজি করে দেশে এভাবেই রাতারাতি গজিয়ে ওঠে এরকমই কিছু ভুঁইফোড় সংগঠন। বিভিন্ন বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানিয়ে/ম্যানেজ করে হাতের কাছে পাওয়া মোক্ষম (গুরুত্বপূর্ণ) ইস্যুতে এরা আয়োজন করে নানা অনুষ্ঠানের। বিশিষ্ট সেইসব ব্যক্তি বা ইস্যুকে পুঁজি করে যাদের মূল লক্ষ্য আসলে আত্ম প্রচারণা। অনেকসময় আয়োজকদের কর্মকান্ডে আমন্ত্রিত অতিথিরাও হন লজ্জিত-অপমানিত।
শনিবারের এ অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করেন ভাষাসৈনিক লায়ন শামসুল হুদা।
প্রধান আলোচক ছিলেন বিচারপতি মো: জয়নাল আবেদীন। অনুষ্ঠান পরিচিতি পুস্তিকায় প্রধান অতিথি হিসেবে নাম লেখা ছিল সাবেক প্রধান বিচারপতি তফাজ্জল ইসলামের। বিশেষ অতিথিদের তালিকাটাও বেশ সমৃদ্ধ। সেখানে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ বদরুল আহসান, দৈনিক প্রথম আলোর সহ-সম্পাদক সোহরাব হাসান, অধ্যাপিকা কবি রুমানা জামান, অধ্যাপিকা শামসুন নাহার প্রমুখের নাম লেখা। এদের কেউই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এদের কাউকে আদৌ আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। শুধু অনুষ্ঠানটির মিডিয়া ফোকাস বাড়ানোর জন্য এসব ব্যক্তির নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আর এই ব্যক্তিবর্গের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন মিডিয়ায় অনুষ্ঠানটি কভার করার জন্য অনুরোধও পাঠানো হয়। উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে নেলসন ম্যান্ডেলার স্মরণ-অনুষ্ঠান। স্বভাবতই দেশের শীর্ষস্থানীয় মিডিয়াগুলো এই ‘গুরুত্বপুর্ণ’ অনুষ্ঠানটি কভার করার জন্য তাদের প্রতিনিধি পাঠায়। একটি টেলিভিশনের প্রতিনিধি অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরক্ত হয়ে ক্যামেরাপার্সনকে নিয়ে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। ছিলেন একুশে টিভি ও চ্যানেল আই’র প্রতিবেদক ও ক্যামেরাপার্সনও।
একুশে টিভির প্রতিবেদক মো: মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমি ভাই এ অনুষ্ঠানের কোনো নিউজ দেব না, তাতে হাউজ আমাকে যা-ই বলুক। ’
বাংলাভিশনের আর এম সালেহ আকরাম তালুকদার বলেন, ‘অ্যাসাইন্টমেন্ট ছিল তাই এসেছি। কিন্তু এসে দেখলাম আমার পুরো বিকেলটাই মাটি। ’
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করতে পুস্তিকায় প্রদত্ত আয়োজকদের নাম্বারে বারবার ফোন করা হলেও কেউই ফোনকল রিসিভ করেন নি।
বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৩
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর