ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহে বেশিরভাগ উচ্চ মাধ্যমিক কলেজেরই নেই নিজস্ব ভবন। শিক্ষা নগরীর অলিগলিতে ভাড়া বাড়িতে গড়ে উঠেছে কলেজ।
এসব কলেজে শিক্ষার্থীদের জন্য নেই সমৃদ্ধ বিজ্ঞানাগার-গ্রন্থাগার। নেই পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষ, মনোরম পরিবেশ কিংবা শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার মাঠ। গাদাগাদি করে বসে ক্লাস করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের অবসরও কাটে বেঞ্চে বসে। ফলে কলেজগুলোর শিক্ষার মান ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেনসচেতন মহল ও শিক্ষাবিদরা।
সূত্র জানায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কলেজ অনুমতির নীতিমালায় একটি কলেজ থেকে আরেকটি কলেজের দূরত্ব কমপক্ষে দুই কিলোমিটার থাকার কথা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে নিজস্ব জমিতে নিজস্ব ভবনে কলেজ থাকারও বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
কিন্তু সরকারি এসব নিয়ম কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শহরের গুলিকিবাড়ি এলাকায় ভাড়া বাড়িতে গড়ে উঠেছে ময়মনসিংহ আইডিয়াল কলেজ। কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালে।
কলেজের কো-অর্ডিনেটর মো: আব্দুল্লাহ আল আমিন জানান, তাদের কলেজে মোট শ্রেণীকক্ষ ৮টি, ব্যবহারিক কক্ষ ৫টি।
যদিও কলেজটির পিয়ন বাদল মিয়া জানান, কলেজটিতে শ্রেণীকক্ষ রয়েছে ৫টি। এ কলেজ থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে মুসলিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এবং ফ্লোরেজ কলেজ। আর কমপক্ষে একশ’ গজ দূরে আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।
ভাড়াটে বাসায় গড়ে উঠা ময়মনসিংহের প্রথম বয়েজ কলেজ ফ্লোরিস কলেজের ঠিক বিপরীতেই মুসলিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। ২০১৩ সালে যাত্রা করা এ কলেজটির ‘ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাটে’র মতো অবস্থা। কলেজটিতে মোট শ্রেণীকক্ষ রয়েছে ৫টি।
সরেজমিনে কথা বলতে গেলে সরকারি এসব নিয়ম ভাঙার বিষয়ে ময়মনসিংহ আইডিয়াল কলেজের পরিচালক (প্রশাসন) হারুন অর রশিদ বলেন, বোর্ডের লোকজন সরেজমিনে পরিদর্শন করেই আমাদের অনুমতি দিয়েছেন।
একই বিষয়ে ফ্লোরেন্স কলেজের প্রভাষক মো: শোয়াইব হোসেন জানান, কলেজ স্থাপনের নিয়ম কানুন সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই।
আরও দেখা যায়, শহরের পণ্ডিতপাড়া এলাকায় মাত্র ২০ গজ দূরত্বে ন্যাশনাল পাবলিক কলেজ ও ময়মনসিংহ সিটি কলেজ। ভাড়া করা একটি ভবনে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল পাবলিক কলেজের ঠিক পাশের দরজা দিয়েই যেতে হয় রংধনু কোচিং সেন্টারে।
এ ভবনেরই আর একটি ফ্লোরে সেলিম’স ইংলিশ লার্নিং হোম নামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ কলেজে শ্রেণীকক্ষ রয়েছে ৫ থেকে ৭টি। একই রকম চিত্র ময়মনসিংহ সিটি কলেজেরও। ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করা এ কলেজে শ্রেণীকক্ষ ৯টি। অতিথি শিক্ষক রয়েছেন ৪ জন।
এ কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক অঘোর মণ্ডল শুভ্র জানান, ন্যাশনাল পাবলিক কলেজের আগে আমাদের কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা সব সরকারি নিয়ম মেনেছি। ওই কলেজটিই কোনো নিয়ম মানেনি।
তবে ন্যাশনাল পাবলিক কলেজের প্রভাষক এমদাদুল হক দাবি করেন, নিয়ম-কানুনের মধ্যে থেকেই তারা কলেজটি করেছেন। নিয়ম মানা হয়েছে বলেই বোর্ডের লোকজন সরেজমিনে ঘুরে এসে কলেজের অনুমতি দিয়েছেন।
শহরের আমলাপাড়ায় দু’টি আবাসিক ভবনে রয়েছে দু’টি কলেজ। এর মধ্যে ক্যাপিটাল কলেজ ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে। আর ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৭ সালে।
ক্যাপিটাল কলেজের প্রসপেক্টাসে ঐতিহ্যবাহী আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের তিনজন ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের নাম রয়েছে। অনাবাসিক সুব্যবস্থার দাবি করা হলেও তা শুধু প্রসপেক্টাস নির্ভর বলে জানায় স্থানীয় একাধিক সূত্র। স্থানীয় এলাকাবাসী যে কারণে এ কলেজটিকে ‘শিক্ষার নামে বাণিজ্য’ বলে নামকরণ করেছেন।
দ্বিতল বিশিষ্ট একটি ভাড়াটিয়া বাসার নিচ তলায় ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল কলেজ। এ কলেজের দোতলায় থাকেন বাসার মালিক। মানহীন এ কলেজে মোট কক্ষের সংখ্যা জানান নি কলেজটির প্রিন্সিপাল আমিনুল ইসলাম। একই বিষয়ে বাসার মালিক ভাস্কর ধরের কাছে জানতে চাইলে তিনি রেগে যান। এ কলেজের বাণিজ্যিক কার্যক্রম নিয়েও ক্ষোভের অন্ত নেই স্থানীয় এলাকার বাসিন্দাদের।
মাত্র ২০ গজ দূরত্বে দু’টি কলেজের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যাপিটাল কলেজের প্রিন্সিপাল মনোয়ার হোসেন খান মনির নিজেকে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও শহরের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আত্মীয় বলে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, কেউ এখন নিয়ম মানে না। এ কারণে আমরাও নিয়ম মানি নি।
একই বিষয়ে ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল কলেজের প্রিন্সিপাল আমিনুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
ওই দু’কলেজ থেকে ৩০ থেকে ৪০ গজ দূরে শহরের রামবাবু রোড এলাকায় গড়ে উঠেছে রিফ্লেক্স মডেল কলেজ। আবাসিক ভবনে চলা এ কলেজটির চেয়ারম্যান ইমরান হোসেন পারভেজ অবশ্য দাবি করেন, গত বছর কলেজটির কার্যক্রম শুরু করেছি। নিয়ম-কানুন মেনেই কলেজ করছি।
সূত্র মতে, ২০০৮ সালে শহরের বাউন্ডারি রোড এলাকায় ভাড়া বাসায় জামায়াত নেতার মালিকানাধীন ম্যাক্সিমের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে প্রাইম সেন্ট্রাল কলেজ। কলেজটির চেয়ারম্যান হচ্ছেন ম্যাক্সিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাবিবুর রহমান।
বর্তমানে এ কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সাবেক জিএস ও ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহেল বাকী। ২০১২ সালে শিক্ষক হিসেবে তিনি কলেজটিতে যোগ দেন। এ বিষয়ে বাকী বলেন. এটি জামায়াতের কোনো কলেজ না। এক বছর আগে আমি এ কলেজটি কিনে নিয়েছি।
এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে তিনি আপত্তি জানান।
ভাড়াটিয়া বাসায় কলেজের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. রফিকুল হক বলেন, ভাড়াটিয়া ভবনে কলেজ যথোপযুক্ত মনে করি না। শিক্ষার নামে তাদের বাণিজ্য শিক্ষা ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
একই বিষয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) ড. মোহিত উল আলম বলেন, ভাড়াটিয়া ভবনে কলেজ মোটেও ঠিক না। প্রতিটি কলেজের নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকা বাঞ্ছনীয়।
এ ব্যাপারে ঢাকা মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ প্রশাসন) ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ বলেন, ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে নিজস্ব জমিতে কলেজ স্থাপনের শর্তে ওইসব কলেজের পাঠদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ওই সময়েও যারা নিজস্ব জমিতে কলেজ স্থাপন করতে পারেননি, এমনকি ভাড়া বাসাতে কলেজের কার্যক্রম চালাচ্ছেন তারা শর্তভঙ্গ করেছেন। বিধি মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
** ময়মনসিংহে কলেজে ভর্তি ফি নিয়ে নৈরাজ্য
বাংলাদেশ সময় : ১০১৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৪