ঢাকা: অনিয়মের যেন শেষ নেই। পদে পদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের লঙ্ঘন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিশাল নামের তালিকা টাঙিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা, ধার করা শিক্ষক দিয়ে ক্লাস চালানো, অবৈধ ক্যাম্পাসসহ নানা অনিয়মে জর্জরিত ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয়।
উপাচার্য হিসেবে যার নাম রয়েছে তার নাম ডিন, বিভাগীয় প্রধানের তালিকাতেও রয়েছে। ইবাইস নাম ব্যবহার করে চলছে দুই বিশ্ববিদ্যালয়। দুই ভাই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিদার। আর তাই একই নামে দু’জনই আলাদা ক্যাম্পাস নিয়ে পরিচালনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়।
মূলত কাওসার হোসেন কমেটের সঙ্গে তার ভাই জাকারিয়া লিকনের দ্বন্দ্বেই বিশ্ববিদ্যালয়টি ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেছে। তবে দুই টুকরা হলেও দু’জনই একই নাম ব্যবহার করছেন।
কাওসার হোসেন কমেট বোর্ড অব ট্রাস্টির ভাইস-চেয়ারম্যান হয়ে চালাচ্ছেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়। একই নামে ইবাইস পরিচালনা করছেন জাকারিয়া লিংকন। তিনি নিজেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি নিজেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আসীন হলেও তার বিস্তারিত শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো উল্লেখ নেই কোথাও।
কাওসার হোসেন কমেটের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আরিফুর রহমান। এই অংশের বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেল। বাংলানিউজের অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
লিংকনের বিশ্ববিদ্যালয়
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরে প্রশাসনিক ভবন নিয়ে ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন জাকারিয়া লিংকন। নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ও প্রতিষ্ঠাতা দাবি করছেন তিনি।
লিংকনের বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ৩৫ নম্বর সড়কে ভবন-২ নামে একটি ক্যাম্পাস রয়েছে। মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটিতে ভবন-১ নামে রয়েছে আরেকটি ক্যাম্পাস। গুলশানের শাহজাদপুরে ভবন-৩ নামে তিনি পরিচালনা করছেন তৃতীয় ক্যাম্পাস। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী এভাবে একাধিক ক্যাম্পাস খোলা যায় না। তবুও এসব নিয়ম তোয়াক্কা না করেই বছরের পর বছর ধরে শিক্ষার নামে বাণিজ্য চালিয়ে আসছেন জাকারিয়া লিংকন।
লিংকনের পরিচালিত ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও উপদেষ্টা হিসেবে শিক্ষক হিসেবে ৮৪ জন শিক্ষকের নাম উল্লেখ তার মধ্যে ৩৫ জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এছাড়া বুয়েটের ৩জন শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন, মালয়েশিয়ার এশিয়া ই ইউনিভার্সিটির ৬ জন শিক্ষক।
এছাড়াও থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববদ্যালয়ের আরো কয়েকজন শিক্ষকের নাম রয়েছে। ইবাইসের শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৬ জন।
৮৪ জন শিক্ষকের নামের তালিকা তাদের ওয়েবাসাইটে এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে কে তাদের স্থায়ী শিক্ষক, যে খণ্ডকালীন শিক্ষক, কে স্থায়ী শিক্ষক আর কে উপদেষ্টা তা বোঝা কঠিন। যেকোনো শিক্ষার্থী শিক্ষকদের এই বিশাল তালিকা দেখে প্রতারিত হতে পারেন।
যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুজিব উদ্দিন আহমেদের নামও ৮৪ জনের তালিকায় রয়েছে। অথচ তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। এ সম্পর্কে অধ্যাপক মুজিব উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে তারা বুদ্ধি-পরামর্শ চাইলে তা দিয়ে সহায়তা করি। কিন্তু আমি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস নেই না। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম মাওলার নামও রয়েছে। এভাবে অনেক শিক্ষকের নামের তালিকা বানিয়ে শিক্ষার্থীদের ধোঁকা দিয়ে ভর্তি করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ইংরেজি, আইন, অর্থনীতি, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিবিএ ও একটি ইনস্টিটিউট রয়েছে লিংকনের বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে বিভাগ ও অনুষদ অনুযায়ী এখানে কতজন শিক্ষক রয়েছেন এবং তাদের বিস্তারিত কোনো প্রোফাইল নেই।
কমেটর বিশ্ববিদ্যালয়
কমেটের বিশ্ববিদ্যালয়েও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ভাঙার নজির রয়েছে। এখানেও একটি শহরে ৩টি ক্যাম্পাস খুলে নিয়ম ভেঙেছেন কমেট। এর মধ্যে ধানমন্ডি ১৬ নম্বর সড়কের ২১/এ বাড়িতে (পুরাতন ২৭) একটি ক্যাম্পাস, একই সড়কের ১৮ নম্বর বাড়িতে রয়েছে আরেকটি ক্যাম্পাস এবং লালমাটিয়ার এ ব্লকে রয়েছে আরো একটি ক্যাম্পাস।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার শিক্ষকদের কোনো তালিকাও নেই। এখানে শিক্ষকের স্বল্পতা এতই ওই শিক্ষকের নাম একাধারে উপাচার্য, অন্যদিকে ডিন এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রাখা হয়েছে। যে কয়েকজন হাতে গোনা শিক্ষক রয়েছেন তাদেরও বিস্তারিত কোনো প্রোফাইল নেই। এর মধ্যে ইংরেজি, আইন বিভাগ ও কম্পিউটার বিভাগ চলছে পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক ছাড়া। এই তিনটি বিভাগে দু’জন জুনিয়র শিক্ষক দিয়ে চালানো হচ্ছে। বিবিএ’র মতো বিভাগেও পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক নেই।
কমেটের বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান হিসেবে ড. আকতার হোসেন নামে একজনের নাম রয়েছে। কোয়ার্ডিনেটর হিসেবে নাম রয়েছে এসএম ফরহাদুজ্জামান আজাদের। এই দুই ব্যক্তির নাম ছাড়া এই বিভাগে আর কোনো শিক্ষকের নাম কিংবা প্রোফাইল কিছুই নেই। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ সম্পর্কে কিছুই নেই।
স্কুল অব বিজনেস ও ইকোনমিকসের ডিন হিসেবে নাম রয়েছে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী আরিফুর রহমানের নাম। বিবিএ’র প্রধান হিসেবে নাম রয়েছেন ড. ফরিদ উদ্দিনের নাম। অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে আবার নাম রয়েছে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আরিফুর রহমানের।
মানবিক ও আইন অনুষদের ডিন হিসেবে নাম রয়েছে অধ্যাপক বেলাল হোসেন জয়ের। ট্যুরিজম অ্যান্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান হিসেবে নাম রয়েছে অধ্যাপক মোহাম্মদ আহসান উল্লাহর। ইংরেজি বিভাগের প্রধান ফারজানা পারভিন। তিনি অধ্যাপক নন, এমনকি তার পিএইচডিও নেই। আইন বিভাগের প্রধান হিসেবে কেউ নেই। এখানে আইন বিভাগের সমন্বয়ক প্রধান হিসেবে নাম রয়েছে সাম্মি আকতারের।
কর্তৃপক্ষের দেখা নেই
ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মালিকানার কর্তৃপক্ষের সঙ্গেই যোগাযোগ করা হয়েছে। জাকারিয়া লিংকনের সঙ্গে কথা বলার জন্য ১৭ জুলাই বেলা সোয়া ১১টার দিকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরার প্রশাসনিক ক্যাম্পাসে ফোন করা হলে ওপাশ থেকে বলা হয়, স্যার এখনো অফিসে আসেন নাই। একথা বলার পর রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বলা হয়, রেজিস্ট্রার ফাহমিদা হক আজ অফিসে আসবেন না।
উপাচার্য অথবা রেজিষ্ট্রারকে কখন পাওয়া যাবে জানতে চাইলে অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, ভিসি স্যার একেক দিন একে অফিসে বসেন। তাই কবে পাওয়া যাবে তা বলা যাবে না। তার মোবাইল নম্বর চাইলে তা দিতে অস্বীকার করা হয়। আর কমেটের বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিকবার ফোন করা হলেও কেউ ফোন ধরেননি। মাহবুবুর রহমানে নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়কের মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
এদিকে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমেই জানতে চান কি বিষয়ে কথা বলতে চাই। বিষয়টি বলার পর তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে ফোন রেখে দেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৪