ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

ওদের স্কুল

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১৫
ওদের স্কুল ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বিবিয়ানা (হবিগঞ্জ) থেকে ফিরে: পাঠ্যপুস্তক ও ব্যবহারিক শিক্ষায় স্কুলে কম্পিউটার বিষয় অর্ন্তভ‍ুক্ত হয়েছে সেই আড়াই দশক আগে। এরপর সময় অনেক পেরিয়েছে, কিন্তু হাতে কলমে শিক্ষা এখনও সীমাবদ্ধ সেই বই-খাতায়।



হতাশার চিত্রের পাশাপাশি কিছু ব্যতিক্রম যে নেই ‍তা নয়। এখনো এমন অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে যারা নীরবে ছড়িয়ে যাচ্ছে আলোকবর্তিকা। তাদের মধ্যে নবীগঞ্জের নাদামপুর উচ্চ ‍বিদ্যালয়কে অন্যতম বললে ভুল হবে না। শতভাগ শিক্ষার্থীকে হাতে কলমে কম্পিউটার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রুপ ভিত্তিক কাম্পিউটার শিক্ষা দেওয়া হয়। বাদ যায়নি কোনো শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরাও সাদরে গ্রহণ করেছে কম্পিউটারকে। টিফিনের সময় বাইরে না ঘুরে কাম্পিউটার ল্যাবরেটরিতে ভীড় জমান বলে জানান কম্পিউটার শিক্ষক সঞ্জিত কুমার মন্ডল।
 
বৃহস্পতিবার (৩০ জুলাই) সরেজমিনে গিয়েও এমন দৃশ্য দেখা যায়। চারজন শিক্ষার্থী (আবিদা রহমান, নাইমা সুলতানা, সানজিদা আক্তার, আজিজা আক্তার আখি) চারটি কম্পিউটারে নিজেদের লেখার হাত ঝালিয়ে নিচ্ছেন। আর তাদের মাথার উপর দিয়ে উ‍ঁকি দিচ্ছেন আরও বেশ কয়েকজন। তারা কিন্তু কেউই মাধ্যমিকের ছাত্রী নন। সবাই সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।

আবিদা রহমান বাংলানিউজকে জানায়, সে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, ইন্টারনেট ব্রাউজিং শিখে ফেলেছে। তারা ১০ জনের ব্যাচ ছিলো, প্রশিক্ষণ নিয়েছে ২ মাসের। প্রথম প্রথম ভয় লাগলেও শেখার পরে এখন খুবই ভালো লাগে।

কম্পি‌উটার চালিয়ে এখন খেলার মতোই আনন্দ পায় আবিদা। তবে কম্পিউটার ব্যবহার করার সুযোগ কম পাওয়ায় তৃপ্তি মেটে না বলে জানায় নাইমা সুলতানা।

কম্পিউটার শিক্ষক সঞ্জিত কুমার মন্ডল বাংলানিউজকে জানান, ওই স্কুলে ৯৪৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। যারা সবাই এখন কম্পি‌উটার চালাতে পারে। ১০ জন করে একেকটি গ্রুপ করে দুই মাসের ট্রেনিং দিয়েছেন। প্রথম দিকে জটিল মনে হলেও এখন সবাইকে ট্রেনিং দেওয়ায় কাজটা সহজ হয়ে গেছে। এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে যারা নতুন আসছে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আর অন্য শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাকটিস করছে প্রতিনিয়ত।

তবে শিক্ষার্থীদের লোডশেডিং নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে। অনেক সময় বিদ্যুতের না থাকয় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় বলে জানায় শিক্ষার্থী সানজিদা আক্তার।
 
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত জনপদের এই স্কুলটিকে পুরিপূর্ণ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বললে খুব বেশি বলা হবে না। ২০০৯ সালে এসএসসিতে সিলেট শিক্ষা বোর্ডে সপ্তম হয়েছে। সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১০ সালে শতভাগ, ২০১১-তে ৯৯ শতাংশ, ২০১৩ ও ২০১৪তে শতভাগ পাস করেছে। শুধু কি শিক্ষা, প্রতিষ্ঠানটির সহশিক্ষা কার্যক্রমও আশাজাগানিয়া। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় সবসময় জমজমাট থাকে পাঠাগার।
 
পাঠাগার থেকে একদিনে ১৫ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থীর বই উত্তোলনের রেকর্ড দেখা গেছে। তবে পছন্দের লেখকের বই না পাওয়ায় কিছুটা অতৃপ্তি আছে বলে জানায় নবম শ্রেণির ছাত্রী শাপলা বেগম। সে জাফর ইকবালের সায়েন্সফিকশন বই পড়তে ভালোবাসে। কিন্তু তার চাহিদামতো বই খুঁজে পায় না।
 
বিদ্যালয়টির সহকারী গ্রন্থাগারিক শামীমা আক্তার চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, পাঠাগারে বসে পড়ার পাশাপাশি অনেকেই নিয়মিত বই নিয়ে যায়।
 
বর্তমানে জৌলুসপূর্ণ নাদামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে কিন্তু আর দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো একসময় সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খেতো। শ্রেণিকক্ষ সংকট, খেলার মাঠ সংকট ও উপকরণ সংকটে ঠিকমতো ক্লাস হতো না।
 
ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি খালেদ আহমেদ পাঠান বাংলানিউজকে জানান, শ্রেণিকক্ষ সংকট দূর করতে কোথায় না গেছি। কিন্তু খুব একটা লাভ হয়নি। নেতারা অনেকেই শুধু আশ্বাস দিয়েছেন কিন্তু ভবন হয়নি। এমন সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ।
 
প্রধান শিক্ষক প্রদীপ রঞ্জন দাস বাংলানিউজকে জানান, তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে এই স্কুলে আছেন। শুরুর দিকে খেলার মাঠ সংকট, শ্রেণিকক্ষের ঘাটতি, এমনকি শিক্ষকের ঘাটতিও ছিলো প্রকট। আজ যে কম্পিউটার ও কম্পি‌উটার ল্যাব দেখলেন সবই হয়েছে শেভরনের অর্থায়নে।
 
প্রধান শিক্ষক জানান, স্কুলের এখন যে মাঠটি রয়েছে তার বেশিরভাগ জুড়েই ছিলো পুকুর। এখানে মাটি ভরাট করে দিয়েছে শেভরন। তারা ২৪ লাখ টাকা খরচ করে একাডেমিক ভবনটির সিঁড়িসহ দুইতলা করে দিয়েছে। মোট বেড়েছে ৪টি কক্ষ। একটি ব্যবহার হচ্ছে পাঠাগার হিসেবে, একটি কম্পিউটার ল্যাব, অন্য দুটি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠদান কক্ষ হিসেবে।
 
ব্যবহার অনুপযোগী পুরাতন টিনশেড ভবনটির দরজা-জানালা ও টিনের ছাউনি পরিবর্তন, ওয়ারিং পরিবর্তন ও নতুন করে প্লাস্টার করে ব্যবহার উপযোগী করে দিয়েছে কোম্পানিটি।

এতে শ্রেণিকক্ষের সংকট অনেকটা কেটে গেছে বলে জানান প্রধান শিক্ষক।
 
৯৪৬ জন শিক্ষার্থীর প্রত্যেক ক্লাসেই শাখা খোলা হয়েছে সুষ্ঠু পাঠদানের জন্য। সেই শাখা অনুমোদনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে ধর্না দিলেও অনুমোদন মিলছিলো না। সে কারণে শিক্ষক সংকটে ধুঁকছিলো নাদামপুর উচ্চ বিদ্যালয়।
 
এখানেও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে শেভরন। সরকার অনুমোদিত শিক্ষকের বাইরে ২০০৭ সালে সম্পা রানী আচার্য (ইংরেজি), সীপা বেগম (বিজ্ঞান) ও সৈয়দা নিগার সুলতানাকে ‍(বাংলা) নিয়োগ দিয়েছে শেভরন। যাদে বেতন-বোনাস নিয়মিত দিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি।
 
স্কুলটির ভবিষ্যত তহবিল সমৃদ্ধ করতে প্রতি মাসে ৬০ হাজার টাকা দেয় শেভরন। ওই টাকার সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষ ৪০ হাজার করে যোগ দিয়ে মোট এক লাখ টাকা করে ভবিষ্যত তহবিলে জমা করছে। যদি কখনও শেভরন সহযোগিতা না দেয় তখন যাতে অতিরিক্ত শিক্ষক রাখা সম্ভব হয়। জানান প্রধান শিক্ষক।

বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত বৃত্তি দিচ্ছে কোম্পানিটি। ২০০৭ সাল থেকে এই বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এ বছর ৫০ জন শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ৪ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।
 
শেভরন বাংলাদেশ’র পরিচালক (এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স) নাসের আহমেদ বাংলানিউজকে জানান, বিবিয়ানাবাসীর জন্য মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ তৈরির জন্য শিক্ষার মান ও পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
 
তিনি বলেন, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। মেধাবী কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের জন্য ২০০৫ সাল থেকে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষক ঘাটতি থাকায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।
 
নাসের আহমেদ বলেন, ১৬টি স্কুল ও মাদ্রাসায় ৬৮০ জনকে বৃত্তি ও ৪টি স্কুলে ৩ জন করে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষারমা ন অনেক এগিয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৫
এসআই/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।