ঢাকা, বুধবার, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৫ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

‘লটারিতেই গণ্ডগোল’

ইসমাইল হোসেন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১৫
‘লটারিতেই গণ্ডগোল’ ফাইল ফটো

ঢাকা: ফাঁস ঠেকাতে কৌশলে প্রশ্নপত্র বিতরণ করে পরীক্ষা গ্রহণে কিছু বোর্ডের ফলাফলে প্রভাব পড়লেও সার্বিকভাবে এইচএসসির ফলাফলে এবার কোন চমক নেই। রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি সৃজনশীল পদ্ধতি ও কঠিন বিষয় খারাপ ফলে প্রভাব রেখেছে।



শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসবের পাশাপাশি পাঠ্যবইয়ের প্রতি অনাগ্রহ, ইন্টারনেটে আসক্তি শিক্ষার্থীদের উপর মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। এর প্রভাব পড়েছে ফলাফলে।

২০১৪ সালের বছর এইচএসসিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ইংরেজি প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর এর কৌশলে লটারির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হয়।

এবছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছে ৬৯ দশমিক ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪২ হাজার ৮৯৪ জন। গত বছর এ পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ; ৭০ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিল।

গত পাঁচ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভাল ফলের ধারাবাহিকতা থাকলেও এবার পাসের হার গত বছরের তুলনায় কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ।

২০১১ সালে পাসের হার ছিল ৭৫ দশমিক ০৮ শতাংশ, ২০১২ সালে ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৭৪ দশমিক ০৩ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৭৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শ্রীকান্ত কুমার চন্দ্র বাংলানিউজকে বলেন, লটারির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র নির্বাচন করে পরীক্ষা গ্রহণ করায় ফলাফলে প্রভাব পড়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

কয়েকটি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বাংলানিউজকে জানান, প্রতি বোর্ডের চার সেট করে প্রশ্ন তৈরি করে ঢাকায় পাঠানো হয়। আটটি বোর্ডের ৩২ সেট প্রশ্নের মধ্যে নিজ নিজ বোর্ডের প্রশ্ন বাদ রেখে লটারি করে চার সেট নির্বাচন করা হয়েছে। কোন বোর্ডের প্রশ্ন কোথায় গেছে তা কেউই বলতে পারেনি।

যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষার্থীদের সাজেশন বানিয়ে বছর ওয়ারি প্রশ্ন পড়ার প্রবণতা থাকে। এবার লটারির কারণে সেই কৌশল খাটেনি। এতে ফলাফলে প্রভাব পড়েছে।
 
একই কথা জানান চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাহবুব হাসানও।

তিনি বলেন, আগে নিজ নিজ বোর্ড প্রশ্নপত্র তৈরি করতো। চলতি বছর থেকে নিজ বোর্ড বাদ দিয়ে বাকি সাত বোর্ডের ২৮ সেট প্রশ্নপত্র থেকে যে কোন চার সেট পছন্দ করা হয়েছে। ফলে আগে শিক্ষার্থীরা সিলেক্টিভ পদ্ধতি অনুসরণ করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিত। এখন ভিন্ন একটি বোর্ডের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ফলাফল ভাল করতে পারেনি।

গত বছর এইচএসসিতে প্রশ্ন ফাঁসের পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আগে থেকেই ৩২ সেট প্রশ্ন করার কথা জানিয়েছিলেন।

তবে লটারির কারণে প্রশ্ন ফাঁসের ঝুঁকি কমে গেছে মন্তব্য করে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সামসুল আলম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, পদার্থ বিজ্ঞান এবং হিসাব বিজ্ঞানের প্রশ্ন কঠিন হয়েছিল বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছিল।

যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বাংলানিউজকে বলেন, প্রশ্নপত্র বিতরণে বোর্ডগুলোর সমন্বয় ছিল না। এ বিষয়টি আন্তঃশিক্ষা বোর্ডকে তিনি চিঠি দিয়ে জানাবেন।  

এ ব্যাপারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, সার্বিক বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

পাস ৩১ শতাংশ!
এবার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে কোন প্রশ্ন না উঠলেও পরীক্ষার আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রস্তুতির বিঘ্নতায় খারাপ ফল হয়েছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী।  

ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ বলেন, জ্বালা-পোড়াও-আতঙ্কের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করতে হয়েছে, এতে বিঘ্ন ঘটেছে প্রস্তুতি।

নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আন্দোলনে বছরের প্রথম তিন মাস হরতাল-অবরোধ পালন করেছে বিএনপপি-জামায়াত জোট।

খারাপ ফলের জন্য ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিএনপি-জামায়াতের জ্বালা-পোড়াওকে দায়ী করেন।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে খারাপ ফলের জন্য দায়ী করে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, এই বোর্ডের অধীনে মাগুরায় মাত্র ৩১ শতাংশ পাসের কারণ সেখানে পরীক্ষার আগে অস্থিরতা ছিল। এছাড়াও সাতক্ষীরাসহ আশেপাশের জেলায় পাসের হার ছিল ৪০ শতাংশের মত।

আর ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্ন ভিন্নতার কারণে খারাপ ফল হয়েছে বলে জানান যশোর বোর্ডের চেয়ারম্যান।

রাজনৈতিক অস্থিরতাকে সার্বিক ফলাফলে পাসের হার কমে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করেছেন রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত ছিল। এতে পাসের হার কিছুটা কমেছে।

সৃজনশীলতা আর ইন্টারনেট বাধা!
এবছর ১২টির বিষয়ের ২৩ পত্রে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। সৃজনশীল পশ্নের কারণে ফলে প্রভাব পড়েছে জানান শিক্ষামন্ত্রী। তবে এ পদ্ধতি চালিয়ে যাওয়ার কথাও জানান নাহিদ।

আর হাতে হাতে স্মার্ট মোবাইল ফোন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে বলে মনে করেন অনেকেই। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কলেজে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ থাকলেও অনেক ছাত্রী লুকিয়ে ফোন নিয়ে আসে। ছাত্রীরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাথরুমে গিয়ে মোবাইলে কথা বলে।

অনেক অভিভাবকই অভিযোগ করেন, তার মেয়ে রাত জেগে পড়ার নামে মোবাইলে ফেসবুক খুলে বসে থাকেন। এভাবে ফেসবুক ব্যবহার করার ফলে শিক্ষার মান দিন দিন খারাপের দিকেই যাবে।

উপরে তারাই
সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকা না থাকলেও বরাবরের মত এবারও ক্যাডেট কলেজ এবং শহরের কলেজগুলো ভাল ফল করেছে। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশের হার ৯৯ দশমিক ৪ শতাংশ। এক হাজার ৪৪১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ফেল করেছে মাত্র চার জন।

এদিকে আইএসপিআর’র সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিদ্যমান ১২টি ক্যাডেট কলেজে এইচএসসি পরীক্ষায় ৬০৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৫৯৫ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। পাসের হার শতভাগ।

সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকা না থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি বলেন, ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়। একজন অকৃতকার্য হলেই ওই প্রতিষ্ঠান ৠাকিংয়ে পিছিয়ে পড়ে। তাই র্যাকিং না থাকায় আমরা সন্তুষ্ট।
ফলাফল বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বৈষম্যের কারণে মফস্বলের কলেজগুলো পিছিয়ে থাকছে। ক্যাডেট কলেজগুলোতে বরাদ্দ বেশি, তারাই ভাল করেছে। মফস্বলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০০৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১৫
এমআইএইচ/এনএস

** আসন নয়, ভাল প্রতিষ্ঠানের সংকট

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।