ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেও ঠিক মত দায়িত্ব পালন করছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আবাসিক হলগুলোর শিক্ষকরা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পাঁচটি ছাত্রী হল ছাড়া অধিকাংশ হলের আবাসিক শিক্ষকরা সংশ্লিষ্ট হলের শিক্ষার্থীদের কাছেই অচেনা।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে খোঁজ নিয়ে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে আবাসিক শিক্ষকদের দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও এখন তা অনেকটাই অকার্যকর। ১৯টি আবাসিক হলে দু’শতাধিক শিক্ষক নিয়োজিত থাকলেও নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে তাদের গাফিলতির বিষয়টি স্পষ্ট। অনেক ক্ষেত্রে হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরাও জানেন না আবাসিক শিক্ষকদের কী কাজ?
১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে প্রাধ্যক্ষ এবং আবাসিক শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে ৪৫টি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৮৫ সালের জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডির পর আবাসিক শিক্ষকদের দায়িত্ব-কর্তব্যে নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবাসিক শিক্ষকদের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জোর দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল পরিচালনায় প্রণীত বিধি অনুযায়ী-দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা প্রতিদিন রাত ৯টায় নিজেদের ফ্লোরে উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের হাজিরা পর্যবেক্ষণ করবেন, শিক্ষার্থীরা আবাসিক শিক্ষকদের উপস্থিতিতে হাজিরা খাতায় সই করবেন, হল প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করে তার উপস্থিতিতেই আবাসিক শিক্ষকদের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করবেন।
এসব নিয়ম থাকলেও কোনো প্রয়োগ নেই। তবে ছাত্রীদের হলে মাঝে মধ্যে হাজিরা ডাকা হয়ে থাকে। হল গেটে রক্ষিত হাজিরা খাতায় তাদের নিয়মিতই স্বাক্ষর করতে হয়। সেখানে অন্যান্য বিষয়ে তদারকিও রয়েছে।
বিভিন্ন হল কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, আবাসিক শিক্ষকদের হলে কমপক্ষে ১০ ঘণ্টার অধিক অবস্থান করার কথা। বর্তমানে তা কমিয়ে রাত ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ এ সময়েও শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব পালন করেন না।
অনেক শিক্ষকই তাদের অন্যতম কর্তব্য মেস ও ক্যান্টিন পর্যবেক্ষণে যান না বলেও অভিযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের। তবে দায়িত্ব পালন না করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত সব সুবিধাই ভোগ করেন আবাসিক শিক্ষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, আবাসিক শিক্ষকরা দায়িত্ব পালনের সুবাদে প্রতিবছর একটি করে পয়েন্ট অর্জন করেন, যা তাদের প্রমোশনের ক্ষেত্রে কাজে লাগে। এই পয়েন্টের ভিত্তিতেই প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দায়িত্বপালন ছাড়াই আবাসিক শিক্ষকরা প্রতিবছর এ পয়েন্ট অর্জন করছেন এবং পদোন্নতি পেয়ে যাচ্ছেন। প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষক হওয়ার সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলো আর হল সংশ্লিষ্ট আবাসিক ভবনে বসবাসের সুবিধা ভোগ করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা। পাচ্ছেন নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্মানীও।
তবে এসব আবাসিক শিক্ষকদের দায়িত্বে অবহেলার পেছনে হলগুলোতে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকে দায়ী করেছেন অনেকেই। হলে
শিক্ষার্থীদের আসন বরাদ্দসহ তাদের দেখাশুনার সব দায়িত্ব প্রশাসনের থাকলেও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় সে কাজগুলো করছে মূলত ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন।
প্রতিটি হলের কয়েকটি রুম দখল করে সেগুলো ‘গণরুম’ বানিয়ে ইচ্ছে মতো শিক্ষার্থীদের হলে তুলছেন ছাত্রনেতারা। এরপর নিজেদের রাজনৈতিক কাজে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে তারাই ঠিক করে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের রুম। এতে আবাসিক শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ হওয়ার সুযোগ খুবই কম থাকে। বেশির ভাগ হলের প্রশাসনই জানে না হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত এবং কে কোন রুমে থাকেন?
এভাবে ‘বড় ভাইদের’ পছন্দ অনুযায়ী রুম বরাদ্দ পাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আবাসিক হওয়ারও প্রয়োজন মনে করেন না। ফলে হল অফিসগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেই সবার যথাযথ তথ্য।
হাজি মুহম্মদ মুহসীন হলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বাংলানিউজকে জানান, প্রথম বর্ষে তাকে গণরুমে তুলে দিয়েছিলেন এক বড় ভাই। দ্বিতীয় বর্ষে তারই পছন্দ মত অন্য রুমে তাকে থাকতে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে প্রশাসনের কোনো ভূমিকাই ছিল না।
তিনি বলেন, আমি যে রুমে আছি, হল প্রশাসন হয়তো জানেও না। তাছাড়া আমি নিজেই জানি না আমার ফ্লোরে আবাসিক শিক্ষক কে? কারণ তাদের কখনও রুমে এসে শিক্ষার্থীদের খোঁজ নিতে দেখিনি।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষকদের শিক্ষাদান ও গবেষণা নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই হয়তো নিয়ম অনুযায়ী তারা সময় দিতে পারেন না। তবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একেবারেই যোগাযোগ না থাকাটা দুঃখজনক।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৫
এসএ/টিআই