জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: জিনসেং একটি বহুল ব্যবহৃত ওষুধি গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ। এর মূলে রয়েছে বিশেষ রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা।
জিনসেং বর্তমানে সারা বিশ্বে একটি আলোচিত ওষুধি মূল। আমেরিকা ও ইউরোপে ফাংশনাল ফুড হিসেবে এটি বহুল প্রচলিত। এর বহুমুখী উপকারিতা, ওষুধি গুণের কথা বিবেচনা করে বিশ্বব্যাপী নতুন নতুন উৎপাদন পদ্ধতির উদ্ভাবন চলছে, যাতে এই মহামূল্যবান ওষুধি উপাদান নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে উৎপাদন করা যায়।
বাংলাদেশেও এ উদ্ভিদটি উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে সফল হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সোহায়েল। দক্ষিণ কোরিয়ার চুংবুক বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনসেং উৎপাদনকারী সহযোগী প্রতিষ্ঠান ওয়েলগ্রিন ইনকরপোরেশনের সহযোগিতায় তিনি বিভাগের সেল জেনেটিক্স, প্লান্ট বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবরেটরিতে জীবপ্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জিনসেং মূলের উৎপাদন শুরু করেছেন।
জিনসেং শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে যে দেশটির নাম উচ্চারিত হয় সেটি হলো কোরিয়া। কোরিয়ান জিনসেং (Panax ginseng Araliaceae) Panax ginseng Araliaceae পরিবারের Pana ধরনের মাংসল মূল বিশিষ্ট বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ প্রজাতি, যা পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে চীন, কোরিয়া ও পূর্ব সাইবেরিয়ার ঠান্ডা পরিবেশে জন্মে এবং এর মূলটিই মূলত ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্যানাক্স শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ panacea থেকে যার অর্থ হল All healer or cure all disease বা সর্ব রোগের ওষুধ। ওষুধ ও শক্তিবর্ধক টনিক হিসেবে বিভিন্ন দেশে জিনসেংয়ের প্রচলন আছে।
আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সোহায়েল জানান, জিনসেং কোরিয়া এবং বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হলেও এর চাষাবাদ বেশ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। মাঠ পর্যায়ে মাটিতে চাষাবাদের জন্য সুনির্দিষ্ট নিম্ন তাপমাত্রার প্রয়োজন। এছাড়াও এর বৃদ্ধি খুব ধীর, চাষাবাদ পরিশ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুল। এভাবে চাষ করলে চারা থেকে বাজারজাত যোগ্য অবস্থায় পৌঁছাতে কমপক্ষে ৫/৭ বছর লেগে যায়।
এটি দূষণ, সংক্রমণ ও কীট-পতঙ্গের আক্রমণ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন হ্রাসের ঝুঁকিতে থাকে। তাই বিভিন্ন দেশে জিনসেং-এর চাহিদা মেটানোর জন্য বিকল্প পদ্ধতিতে জিনসেং মূলের টিস্যু থেকে জীবাণুমুক্ত পরিবেশে জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ জিনসেং মূল উৎপাদন করা হয়।
বাংলাদেশে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে এবং ওষুধ কো¤পানিগুলো বিদেশ থেকে এই মহামূল্যবান জিনসেং মূল আমদানি করছে। এই গবেষণা প্রয়াসটি সফল হলে বাংলাদেশেই কোরিয়া ও চীনের মতো জিনসেং মূলের বিপুল উৎপাদন করা সম্ভব।
দক্ষিণ কোরিয়ার চুংবুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পেক কি ইউপ পরীক্ষাগারে জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে জিনসেং উৎপাদনের বিস্তার ও বিপ্লব ঘটিয়েছেন। ড. সোহায়েল চুংবুক বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. পেক কি ইউপ এর অধীনে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। ড. পেক কি ইউপ এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশে এই প্রথম বারের মতো জিনসেং মূলের উৎপাদন শুরু করেন ড. সোহায়েল।
জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত জিনসেং মূল খুব সহজেই বায়োরিয়্যাক্টরের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা সম্ভব। এজন্য ওই ল্যাবে প্লান্ট বায়োরিয়্যাক্টর চালু করা হয়েছে। জিনসেংয়ে রয়েছে স্যাপোনিন ও জিনসেনোসাইডস। প্রায় ৩০ প্রকারের জিনসেনোসাইডস (Rb, Rg and Ro গ্রুপ ইত্যাদি)। এছাড়াও এতে রয়েছে কার্বোহাইড্রেট, নাইট্রোজেন যুক্ত যৌগ, ফ্যাট-দ্রবীভূতকারী পদার্থ, প্যানাক্সান নামক পেপটাইডোগ্লাইকেন, মিনারেলস প্রভৃতি।
এছাড়াও রয়েছে ফেনলিক যৌগ, যার রয়েছে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ, পলিঅ্যাসিটিলিন যা ক্যানসার কোষ ধ্বংসে ভূমিকা রাখে। জিনসেং স্নায়ুতন্ত্রের উপর সরাসরি কাজ করে যেমন- মানসিক ক্ষমতা, মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি, কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারার ক্ষমতা, কল্পনা শক্তি, শেখার ক্ষমতা, বিচার-বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি ও সমস্যা সমাধান করে কোনো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষমতা ইত্যাদি বাড়ায়।
জিনসেং টাইপ-২ ডায়াবেটিস ম্যানেজমেন্টে কার্যকরী বলে প্রমাণিত। বর্তমানে ওষুধের পাশাপাশি প্রসাধন ও খাদ্য শিল্পে জিনসেং বহুল ব্যবহৃত। যার মধ্যে ত্বক ফর্সাকারী সাবান, ফর্সাকারী ক্রিম, সানস্ক্রিন, টুথপেস্ট, হেয়ারটনিক, শ্যাম্পু, এনার্জি ড্রিংক, ক্যান্ডি, বিভিন্ন বেভারেজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ড. সোহায়েল মনে করেন, বাংলাদেশে জিনসেং মাটিতে চাষ অসম্ভব হলেও জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে এর উৎপাদন, উন্নয়ন ও বাণিজ্যিকীকরণ সম্ভব। বর্তমানে কোরিয়ান জিনসেং দেশের মাটিতেও জন্মানো যায় কিনা এ বিষয়ে গবেষণা চলছে।
এর মাধ্যমে সাফল্য অর্জিত হলে অর্থনৈতিক ও কৃষির পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য উন্নয়নেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা সম্ভব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৫
এএ