ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিক্ষা

বিশ্বসেরা শিক্ষকের পুরস্কার এনে দিলো পথশিশুরা

বেলাল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৬
বিশ্বসেরা শিক্ষকের পুরস্কার এনে দিলো পথশিশুরা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সাদমান ও শামীম। বয়সে দু’জনেই শিশু। একজন পেশায় সেলুন শ্রমিক অন্যহন লেদ শ্রমিক। অভাব তাদের এ পেশায় নামতে বাধ্য করে। পড়াশোনা করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে ইচ্ছে শক্তির কোনো কমতি ছিল না।

বগুড়া: সাদমান ও শামীম। বয়সে দু’জনেই শিশু।

একজন পেশায় সেলুন শ্রমিক অন্যহন লেদ শ্রমিক। অভাব তাদের এ পেশায় নামতে বাধ্য করে। পড়াশোনা করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে ইচ্ছে শক্তির কোনো কমতি ছিল না।

২০১৩ সালের কথা। দুই শিশুকে পড়াশোনা শেখানোর দায়িত্ব নেন এক শিক্ষিকা। তার বাড়িতে হাতেখড়ি ওই দুই শিশুর। নতুন জীবনের শুরুটা তখন থেকেই। আস্তে আস্তে তারা ওপর ক্লাসে উঠতে থাকে। দেখাদেখি অনেক কর্মজীবী শিশুই ওই শিক্ষিকার কাছে ছুটে যায়।

বাড়তে থাকে কর্মজীবী শিশু শিক্ষার্থীর সংখ্যা। চিন্তায় পড়ে যান শিক্ষিকা। কিন্তু পথশিশুদের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল তিনি। সাহায্য নেন স্বামীর। নিজ এলাকায় ভাড়া নেন একটি বাসা। গড়েন কর্মজীবী পথশিশুদের স্কুল। নাম দেন ‘শেরপুর শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
 
২০১৫ সালের শুরুর দিকে স্কুলটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০জনে। সবাই সমাজের অসহায় ঝরে পড়া অভাবী পরিবারের কর্মজীবী পথশিশু। সপ্তাহের ৬দিন বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলে স্কুলের পাঠদান কার্যক্রম।
 
এদের পরিধেয় পোশাক, বইপুস্তক, খাতা-কলমসহ লেখাপড়ার যাবতীয় যোগান দেন ওই শিক্ষিকা। পাঠদান কার্যক্রমের সুবিধার্থে দু’জন শিক্ষক নিয়োগ দেন তিনি। তাদের বেতনভাতার ব্যয়ও বহন করেন তিনি।
 
পুরো আয়োজনের পেছনের কারিগর শাহনাজ পারভীন। বগুড়া উপজেলা সদর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে বর্তমানে কর্মরত। পৌরশহরের শান্তিনগরে বসবাস করেন তিনি। এ এলাকায় গড়ে তোলা স্কুলে কর্মজীবী পথশিশুদের নিয়ে চলে তার কর্মযজ্ঞ।
 
শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় শাহনাজ পারভীনের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে এসব তথ্য উঠে আসে।
বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের নিয়ে শাহনাজ পারভীনতার এসব কাজের স্বীকৃতিও দিয়েছে বিশ্ব। বিশ্বসেরা শিক্ষক-২০১৭ (গ্লোবাল টিচার প্রাইজ) পুরস্কারে মনোনীত হয়েছেন তিনি। লন্ডনভিত্তিক ভার্কি ফাউন্ডেশন বিশ্বের ১৭৯টি দেশ থেকে প্রাপ্ত বিশ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে ৫০ জনের একটি তালিকা প্রণনয়ন করে।
 
গ্লোবাল টিচার’র পুরস্কারের জন্য প্রণীত তালিকায় বাংলাদেশি হিসেবে নাম রয়েছে তার। সঙ্গে এ তালিকায় ভারত, পাকিস্থানসহ ৩৭টি দেশের একজন করে শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত পথশিশুদের শিক্ষাদানে বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতি দিতেই সংস্থারটি পক্ষ থেকে তৃতীয়বারের মতো এই পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
 
আগামী বছরের ১৯ মার্চ দুবাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে। পাশাপাশি বিজয়ীদের ১০ লাখ মার্কিন ডলার অর্থ পুরস্কারও দেওয়া হবে।

আলাপচারিতায় শাহনাজ পারভীন বাংলানিউজকে বলেন, ‘অভাব-অনটন অনেক শিশুকে স্কুলের বারান্দায় যেতে দিচ্ছে না। আবার অনেক শিশু একই সমস্যার শিকারে পরিণত হয়ে স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ছে। এসব শিশুদের অনেকেই প্রচণ্ড মেধাবী। কিন্তু অভাব তাদের কর্মজীবীর তালিকায় নাম লেখাতে বাধ্য করছে।

চোখের সামনে হরহামেশাই ঘটনাগুলো ঘটে চলছে। যা কখনো মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। তাই শিক্ষকতার পাশাপাশি তাদের জন্য কিছু করার উদ্যোগ নেই। প্রথমে বাড়িতে স্বল্প পরিসরে কার্যক্রম শুরু করি। পরে স্কুল প্রতিষ্ঠা করি। সেখানে সাধ্যানুযায়ি এসব সুবিধা বঞ্চিত কর্মজীবী পথশিশুদের লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। ’
 
পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়ায় ভীষণ খুশি ও আনন্দিত বলেও মন্তব্য করেন শাহনাজ পারভীন। পাশাপাশি চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে দেশবাসীর দোয়া কামনা করেন তিনি।
 
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুম বাংলানিউজকে বলেন, এক কথায় শাহনাজ পারভীন একজন আদর্শ শিক্ষিকা। তিনি শিক্ষক সমাজের জন্য অনুকরণীয়। তিনি আমাদের গৌরব।
 
১৯৭৬ সালে বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার দাঁড়িগাছা গ্রামে শিক্ষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শাহনাজ পারভীন। বাবা মরহুম মানিক উল্লাহ ও মা মিসেস নুরজাহান বেগম।  

১৯৮৫ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি লাভ করেন শাহনাজ। ১৯৯২ সালে মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে আলিম পাশ করেন তিনি। এরপর বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধন লিখে আসছেন।
 
২০১০ সালে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ক্লাব লিডার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ২০১৭ সালে একুশে পদক পাওয়ার জন্য রাজশাহী বিভাগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।

চার সদস্যের সংসার তার। বড় মেয়ে মাসুমা মরিয়ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রথমবর্ষে অধ্যয়নরত। ছোট মেয়ে আমেনা মুমতারিন শ্রেয়া বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্বামী মোহাম্মাদ আলী শেরপুর শহীদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় আরবি প্রভাষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৩৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৬
এমবিএইচ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।