রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, শীত কিংবা ঘন কুয়াশা কোনোটাই স্কুলে আসা থেকে থামিয়ে রাখতে পারে না এসব দূরন্ত ‘সাইকেল বালিকাদের’।
বাগেরহাট জেলার বৈটপুরের চিতলি গ্রামে সামছউদ্দীন-নাহার ট্রাস্ট পরিচালিত এ স্কুলটির অনেক ছাত্রী বাড়ি থেকে স্কুলের পাঁচ-সাত কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় সাইকেলে।
স্কুলে আসার পথে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় তার। নওরীন জানায়, ৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বেড়গজালিয়া গ্রাম থেকে প্রতিদিন স্কুলে আসি। প্রথম যখন সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতে শুরু করি গ্রামের মানুষ তখন সমর্থন করেনি। বরং নানা কটূক্তি করেছে। সেদিকে কান না দিয়ে ‘আলোর পথে’ সাইকেল চালিয়েছি। এখন আর প্রতিবন্ধকতা মনে হয়না। আমার দেখাদেখি আরও অনেক মেয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসা শুরু করে।
সঙ্গে থাকা মানবিক বিভাগের ৯ম শ্রেণির সানজিদা রহমান মিম সাইকেল চালিয়ে নিজের স্কুলে আসার গল্পের বর্ণনা নিতে গিয়ে বলে, প্রথম প্রথম ফতেপুর গ্রাম থেকে আসার সময় অনেকে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু সাইকেল আমার সময় ও খরচ বাঁচিয়ে দিয়েছে। আমি সময়মতো স্কুলে আসতে পারি।
তারা জানায়, স্কুলে আসা-যাওয়াসহ অন্যান্য কাজেও সাইকেল ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের দেখাদেখি এখন স্কুলের অনেক মেয়ে দূর-দূরান্ত থেকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে।
স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা আইরিন সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, মেয়েরা সাইকেলে স্কুলে আসার কারণে এখন আর দেরি হয়না। সাইকেলের কারণে দূর-দূরান্তের যেসব মেয়েরা পড়ালেখা করতে পারতো না এখন তারাও সে সুযোগ পাচ্ছে। কেননা এখন আর মেয়েদের স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য অভিভাবকদের অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে না।
তিনি জানান, এ স্কুলের মেয়েরা এখন আশেপাশের অনেক স্কুলের মেয়েদের কাছে মডেল।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক দিপঙ্কর পাল বাংলানিউজকে বলেন, দূর-দূরান্ত থেকে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা স্কুলে সাইকেল চালিয়ে আসে। নওরীন নামের একটি মেয়ে ২০১৬ সালে গ্রামের ৬ মাইল কাঁচা-পাকাপথ পাড়ি দিয়ে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে শতভাগ উপস্থিত হয়েছে।
তিনি জানান, মেয়ে শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড (যশোর) কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি উচ্চমানসম্পন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে স্কুলটি পরিচিতি পেয়েছে।
প্রধান শিক্ষিকা আরও জানান, স্কুলে উন্নত বিজ্ঞানাগার, পাঠাগার ও গণিত, ইংরেজি ক্লাব কার্যক্রম চালু আছে। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ উন্নত পাঠদানের সহায়ক যাবতীয় উপকরণ ব্যবহার করা হয় এখানে। প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে আবৃত্তি, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, অঙ্কন, খেলাধুলা ও শরীরচর্চা করানো এবং প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা রয়েছে। স্কুলটিতে ২০টি কম্পিউটার সমৃদ্ধ সুসজ্জিত ল্যাব রয়েছে। যেখানে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে।
সামছউদ্দীন-নাহার ট্রাস্টের চিফ ফ্যাসিলিটেটর সুব্রত কুমার মুখার্জী বাংলানিউজকে বলেন, ২০০৭ সালে খাদিজা নামের একটি মেয়েকে প্রশিক্ষক হিসেবে এনে স্কুলের মেয়েদের সাইকেল চালানোয় উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এরপর থেকে এক এক করে মেয়েরা সাইকেল নির্ভর হতে শুরু করেছে। সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়ায় এই মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বেড়েছে আত্মবিশ্বাস।
তিনি জানান, গাঁয়ের লোকজন প্রথমে মেয়েদের সাইকেল চালানো ইতিবাচকভাবে নিতে না পারলেও এখন নিয়েছে। তাই এখানকার মেয়েরা ভেদাভেদের বালাই না রেখে ছেলেদের পাশাপাশি নিজেদের অবস্থান করতে পেরেছে।
সামছউদ্দীন-নাহার ট্রাস্ট ২০০২ সালে বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নে আধুনিক প্রযুক্তি ও সুস্বাস্থ্য সেবা সমৃদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। ২০০৭ সালে শিক্ষা, স্বাস্থ্য পাশাপাশি তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ট্রাস্টের শিক্ষা বিভাগের নাম উদ্দীপন বদর সামছু বিদ্যানিকেতন। স্বাস্থ্য বিভাগের নাম সামছউদ্দীন-শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র। কম্পিউটার বিভাগের নাম-ওয়াজেদ মেমোরিয়াল কম্পিউটার কেন্দ্র। তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের সময় এ ইউনিয়নে সাইকেল চালিয়ে কাজ করার মতো একজন নারীও পাওয়া যায় না। বর্তমানে বিদ্যালয়ের বেশ কিছু ছাত্রী, সাতজন স্বাস্থ্য কর্মী, পাশ্ববর্তী ব্রাক এনজিওতে নারীরা সাইকেল চালিয়ে কাজ করছেন।
সাইকেল মেয়েদের ছুটে চলার দৃশ্য যেন স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ারই পূর্বাভাস বলে মন্তব্য করেন সুব্রত কুমার মুখার্জী।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১৭
এমআরএম/জেডএস