ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

ঢাবিতে শিক্ষক নিয়োগে ‘অনিয়ম’ই নিয়ম

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০১৭
ঢাবিতে শিক্ষক নিয়োগে ‘অনিয়ম’ই নিয়ম আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দ্বিতীয় মেয়াদে ঢাবি উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন

ঢাকা: দর্শন বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে যোগ্যতার শর্তে ছিল, প্রার্থীর এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ন্যূনতম ৪.২৫ থাকতে হবে। অথচ একজন প্রার্থী নিয়োগ পেয়ে যান ৩.১৯ জিপিএ প্রাপ্ত হয়েও। আবার ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে নানা শর্তের প্রজ্ঞাপনে প্রথম সারির ফলাফলকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও নিয়োগ-বঞ্চিত হন বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া এক প্রার্থী। অথচ নিয়োগ পান ওই বিভাগের ১৯তম স্থান অধিকারী। এমনকি স্নাতকোত্তর ছাড়াই হয়ে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক।

এমনই ‘অনিয়ম’ ‘নিয়ম’ হয়ে চলছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি)। অনিয়মের ব্যাপকতায় বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) একজন শিক্ষকের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে এক আদেশ প্রদানকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা মন্তব্য করেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

অনিয়মের সমালোচক শিক্ষকদের একটি অংশের অভিযোগ, দলীয় রাজনীতি এবং বর্তমানে উপাচার্য (ভিসি) আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে প্রশাসনিক ক্ষমতায় থাকা অংশটি নিজেদের অনুসারী বাড়াতে শিক্ষক নিয়োগে এ অনিয়ম করেছে। অনিয়ম সহজ করতে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করার পাশাপাশি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্তও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এমনকি নিয়োগ হয়েছে বিজ্ঞপ্তি ছাড়া, স্নাতকোত্তর ডিগ্রিহীন প্রার্থীরও!

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, দেশের সর্বোচ্চ এ বিদ্যাপীঠে এখন শিক্ষক রয়েছেন ১ হাজার ৯৯২ জন। বর্তমান ভিসি ২০০৯ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর তার সাড়ে ৮ বছরের মেয়াদে ৯০৭ জন নিয়োগ পেয়েছেন। এরমধ্যে শেষ ৩ বছরে নিয়োগ হয়েছে ৩৫০ শিক্ষকের।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এই তিন বছরের নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল এবং যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নেওয়া হয়েছে অন্তত ৭৮ জনকে। আর দুই বিভাগে ১০ জন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ না করেই। এছাড়া, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা সংখ্যার চেয়ে অতিরিক্ত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মোট ৪১ শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় স্নাতকোত্তর ছাড়াও নিয়োগ হয়েছে কমপক্ষে তিনজনের।  

অনুসন্ধান বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীনদের সমর্থক শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব এই অনিয়মের পেছনে কাজ করেছে বেশি। দু’ভাগে বিভক্ত নীল দলের একাংশের নেতৃত্বে আছেন ভিসি আরেফিন সিদ্দিক, আরেক অংশের নেতৃত্বে বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এস এম মাকসুদ কামালসহ নীল দলের কিছু সিনিয়র নেতা। আরেফিন সিদ্দিক তৃতীয় মেয়াদে ভিসি হওয়ার চেষ্টা শুরু করলে এ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়।

মাকসুদ কামালপন্থি নীল দলের শিক্ষকদের অভিযোগ, চার বছর আগে দ্বিতীয় মেয়াদে ভিসি হওয়ার পর থেকেই আরেফিন সিদ্দিক তার অনুসারী বাড়াতে নিয়মবহির্ভূতভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া শুরু করেন। সেজন্য অনেক সময় নিয়োগ বোর্ডকে ভিসি প্রভাবিতও করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডে বেশিরভাগ সময় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরীন আহমাদ এবং সাবেক সহ-উপাচার্য হারুন-অর-রশিদ। অনিয়মের এসব অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে এলে বরাবরই এই বোর্ডের ওপর দায় চাপিয়েছেন ভিসি আরেফিন সিদ্দিক।

বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগ বোর্ডে দায়িত্ব পালন করা কয়েকজন শিক্ষক জানান, শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে সাধারণত ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ-৪ এর মধ্যে ৩.৫০ এবং এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫-এর মধ্যে ৪.২৫ থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেওয়াজ অনুযায়ী, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ৩.৭৫ পাওয়াকেও অনেক সময় প্রার্থীর যোগ্যতার মানদণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভাগের প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান লাভ করা প্রার্থীকেই দেওয়া হয় অগ্রাধিকার।

প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, গত ১২ জুলাই ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগে দু’টি স্থায়ী ও তিনটি অস্থায়ী পদের জন্য মোট ৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্তদের ৬ জনের আবেদন করারই ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল না। স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে প্রথম দিকের ফলাফলধারীদের অগ্রাধিকারের কথা থাকলেও যোগ্যতা শিথিল করে ৩.৭৫ চাওয়া হয়। অথচ নিয়োগপ্রাপ্ত নয়জনের ফল বলছে, তারা ৩.৬১ থেকে ৩.৭১ পর্যন্ত পেয়েছেন।

এর আগে, গত বছরের ১৬ আগস্ট কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে দু’টি স্থায়ী প্রভাষক পদে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ১১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তি ছাড়া অস্থায়ী পদে নেওয়া ৪ জনকে দেওয়া হয় স্থায়ী নিয়োগ। আর নতুন নিয়োগ দেওয়া হয় আরও ৫ জনকে। মাস দু’য়েক পর অক্টোবরে ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত ৯ জনের মধ্যে নজিরবিহীনভাবে ৩ জন নিয়োগ পান স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছাড়াই।

এই অনিয়ম যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত সাধারণ শিক্ষকদের উদ্বিগ্ন করছে, তেমনি উদ্বিগ্ন করছে প্রধান বিচারপতিকেও। সেজন্য যোগ্যতা পূরণ না করে নিয়োগপ্রাপ্ত তোফায়েল আহমেদ নামে ওই শিক্ষকের নিয়োগ অবৈধ রাখার আদেশ বহাল রেখে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘একজন ভিসি (নাম উল্লেখ না করে) পর্যন্ত নিয়ম বজায় রেখে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তখন বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হতেন, তাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো। কিন্তু এখন আর তা হচ্ছে না। এটা সতর্ক সংকেত। ’

এ বিষয়ে দেশের প্রথম সারির একাধিক দৈনিক শুক্রবার (৪ ‍আগস্ট) বিশেষ প্রতিবেদনও করেছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯১১ ঘণ্টা, আগস্ট ০৪, ২০১৭
এইচএ/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।