সরেজমিনে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার টাপুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে গিয়ে দেখা যায় শিশুদের শুদ্ধ ও প্রমিত উচ্চারণ শিক্ষার অভিনব এ উদ্যোগ।
সেখানে শুদ্ধ উচ্চারণের একটি ধ্বনি চার্ট দেখে দেখে একজন পড়ছে, অন্যরা তার সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে মুখ মেলাচ্ছে.....কা....খা....গা.....ঘা....।
শিশু শিক্ষার্থী শিলা, সিহাব, সুমি, রোহানসহ আরো বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা বলে, সপ্তাহে তিন দিন এখানে স্কুল ছুটির পর পড়তে আসি। আপা আমাদের নিয়ে গান করেন, গল্প শোনান, আমরা উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ করে পড়ি।
তারা আরো বলে, এক মিনিট করে প্রত্যেকে বই পড়ে আপাকে শোনাই, পড়তে গিয়ে আমাদের যার যেখানে সমস্যা আপা শিখিয়ে দেন। আমরা আনন্দের সঙ্গে খেলতে খেলতে পড়তে শিখি।
শিক্ষার্থীদের অভিভাবক আফরোজা বেগম বলেন, মোর ছাওয়া কোনাক আগত প্রাইভেট পড়াইছিনুং, এলা আর প্রাউভেট পড়া নাগেনা এটে কোনায় পড়া হয়।
অভিভাবক রেশমা ইয়াসমীন বলেন, শিলা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়লেও ভালোভাবে রিডিং পড়তে পারতো না। এখন শুদ্ধ উচ্চারণে ঝরঝরে পড়তে পারে।
টাপুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কল্পনা রানী বাংলানিউজকে বলেন, কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্প হলো বিদ্যালয়ের বাইরে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিশুদের বাংলা পড়তে শেখার একটি উপযুক্ত স্থান, যা বিদ্যালয়কেই সহায়তা করছে। অল্পদিনের মধ্যে শিক্ষার্থীরা শুদ্ধভাবে বাংলা উচ্চারণ করতে পারছে, পড়তে পারছে। শিশুদের বাংলা পঠন দক্ষতায় তারা এখন প্রত্যেকেই বিদ্যালয়মুখী। কমেছে অনুপস্থিতির হার। বাংলা বিষয়ে নম্বর প্রাপ্তির হারও বেড়েছে আগের তুলনায়।
কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্প প্রকল্পের সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার নাসিম উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, বিদ্যালয়ের বাইরে মুক্ত পরিবেশে, আনন্দের সঙ্গে খেলার মাধ্যমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিশুরা এখন শুদ্ধ ও প্রমিত উচ্চারণে বাংলা পড়তে শিখছে। শিশুদের শুদ্ধভাবে বাংলা পড়ার ভিত তৈরিতে সহায়তা করছে কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্প।
তিনি আরো জানান, কুড়িগ্রাম সদর ও উলিপুর উপজেলায় ১৩২টি কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পের মাধ্যমে ৯ হাজার ৬৮৮জন শিক্ষাথীর পঠন-দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছে। ইউএসএইড এর আর্থিক সহায়তায় সেভ দ্য চিলড্রেন এর কারিগরি সহযোগিতায় আরডিআরএস বাংলাদেশ প্রকল্পটি পরিচালনা করছে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার টাপুরচর কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পের সহায়ক নাজমুল হোসেন ও রনজিনা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, শুদ্ধভাবে বাংলা পড়তে ৫টি উপাদানের উপর আমরা প্রশিক্ষণ নিয়ে সে অনুযায়ী বিদ্যালয়ের ক্লাস শেষে বাড়ির পড়া তৈরিতে শিশুদের সহযোগিতা করছি।
তারা আরো বলেন, এখানে শিশুরা মুক্ত খেলা ও নাম স্বাক্ষর, গানের সময়, আমরা যা যা করবো, গল্প বলা, মূল কাজ, হাতে-কলমে কাজ, সাময়িকী উন্নয়ন ও লেখা অনুশীলন এবং অনানুষ্ঠানিক মূল্যায়ন- এই ৮টি ধাপে বাংলা পঠন দক্ষতা উন্নয়নে নিজেদের সমৃদ্ধ করছে। শিশুরা এগুলো আগ্রহ নিয়েই শিখছে।
কমিউনিটি রিডিং প্রকল্পের সিনিয়র টেকনিক্যাল কর্মকর্তা আরেফিনা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পের সহায়কদের ধ্বনি সচেতনতা, বর্ণ জ্ঞান, শব্দ ভাণ্ডার, স্বাবলম্বিতা ও বোধগম্যতা- এই বিষয়গুলো উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও শিশুদের শিখনে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে প্রতিমাসে দু’দিন করে তার উপর ফলোআপ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ক্লাসের শিক্ষকদের পাড়াশোনাগুলোই মূলত খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুদের শেখানো হয়।
তিনি আরো বলেন, সহায়কদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ দু’জন করে সহকারী শিক্ষককেও একই প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মাধ্যমেও ক্লাসে শিশুদের শেখানো হচ্ছে। এখানে শিশুরা একদিকে যেমন শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা পড়তে শিখছে, তেমনি বিভিন্ন মানবিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের বিবেকবান মানুষ হিসেবে তৈরি করছে। ক্যাম্প থেকে প্রতি সপ্তাহে শিশুদের পড়ার জন্য শিশুর উপযোগী গল্পের বই দেওয়া হয়। এর ফলে পাঠ্য বইয়ের বাইরেও তার পড়ার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৭
এফইএস/এএ