ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

বদলে যাওয়া স্কুল

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৮
বদলে যাওয়া স্কুল প্রকাশনাথ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রী-ছবি-বাংলানিউজ

নেত্রকোনা থেকে ফিরে: আগে ৬০ শতাংশের মতো উপস্থিতি হতো। এখন ছাত্রীর উপস্থিতি ৮৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সামান্যের যে বিশালতা আমরাও আগে বুঝতে পারিনি। বলতে পারেন চমকে গেছি।

হাওরবেষ্টিত প্রকাশনাথ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক নারায়ণ চন্দ্র পাল এমন মন্তব্য করেছেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ঋতু প্রকল্পের মাধ্যমে মেয়েদের স্বাস্থ্যকর মাসিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করায় এই অবাক করা সাফল্য এসেছে।


 
শুধু কি উপস্থিতির হার বেড়েছে তেমনটি কিন্তু নয়। এখন স্কুলের রেজাল্টেও এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। মেয়েরা মাসিকের সময় স্কুলে আসতো না। এতে তার পড়ার গ্যাপ তৈরি হতো। সেই গ্যাপ পূরণ না হতেই পরের মাসে আবার স্কুলে আসা বন্ধ। এভাবে মেয়েরা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতো। এখন যেহেতু স্কুল কামাই করার সুযোগ নেই, তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে হাতেনাতে।
 
অভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে সাতগাঁও মিরবক্স পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক সুদর্শন চন্দ্র সরকারের কাছ থেকেও। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৬ সালে একটি এনজিও’র সহায়তায় ছাত্রীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়। এরপর থেকে উপস্থিতির হার বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে গড় পাসের হারও।  
 
তিনি বলেন, ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সাতগাঁও স্কুলের ২০১৬ সালে এসএসসিতে পাসের হার ৯৭ দশমিক ২৯, ২০১৭ সালে ৯১ দশমিক ৩০ এবং ২০১৮ সালে অন্য স্কুলের পাসের হার কমলেও আমাদের স্কুলের পাসের হার ৯৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ অর্জিত হয়েছে।
 
সুদর্শন চন্দ্র বলেন, আগে দেখা যেত মেয়েরা স্কুলে আসার পরও শারীরিক সমস্যার কথা বলে বাড়ি চলে যেতো। অনেক সময় কেউ কেউ হয়তো ফাঁকি দেওয়ার জন্যও বলতো। কিন্তু আমাদের কিছুই করার থাকতো না। এখন কিন্তু স্কুলে তাদের সব ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ক্লাসে একটি ভলেন্টিয়ার টিম রয়েছে। আবার একজন শিক্ষক রয়েছে যার কাছে জমা থাকে স্যানিটারি ন্যাপকিন ও অন্য ফার্স্ট এইড।
 
মেয়েরা স্কুলে এসে হঠাৎ মাসিক হলে সঙ্গে সঙ্গে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া হচ্ছে। এতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে পরবর্তী ক্লাসগুলো করে বাড়ি ফিরছে। আবার পরদিনও নিয়মিত ক্লাসে অংশ নিতে পারছে। ছোট্ট একটি বিষয়ে আমরা আগে অজ্ঞ ছিলাম। এটা নিয়ে অনেক লুকোছাপা করা হতো। এতে সমস্যার মূলে আমরা যেতে পারতাম না। এখন আমরা এটাকে কোনো মেয়েলি রোগ হিসেবে নয়, স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে দেখি-যোগ করেন তিনি।
 
শরীরচর্চা শিক্ষক আহসান কবীর বাংলানিউজকে জানান, নারী শিক্ষার জন্য এটা খুবই জরুরি। দেশের সব স্কুলে এই ব্যবস্থা করা গেলে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা পাওয়া যাবে।
 
সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিহা চৌধুরী বলেন, বড় আপুদের কাছে শুনেছি। তারা স্কুলে এসে অনেক সমস্যায় পড়তো। কিন্তু আমরা স্কুল থেকে সব ধরনের সহায়তা পাই। কোনো সমস্যা হলে ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে সবকিছু পেয়ে যাই।
 
সবচেয়ে বেশি যে পরিবর্তন এসেছে তা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা। তারা এখন এটাকে আর কোনো রোগ বা সমস্যা মনে করে না বা এটাকে নিয়ে রাখঢাক করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। তারা খোলামেলা একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করে, এমনকি পরিবারের অন্যদের সঙ্গেও।
 
মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা ডা. এলভিনা মুসতারী বাংলানিউজকে জানান, একটা সময় ছিলো কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করার নির্দেশনা দেওয়া হতো। বাবাকেও জানতে দেওয়া হতো না। মা জানার পর তাকে গোপন রাখার নির্দেশ দিতো। এতে কি হতো, যখন তার সবচেয়ে বেশি সহায়তা এবং পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার, সে সহায়তা থেকে বঞ্চিত হতো।
 
তিনি বলেন, গোপনীয়তা রক্ষা করতে গিয়ে অনেকে অস্বাস্থ্যকর জীবাণুযুক্ত কাপড় ব্যবহার করতে বাধ্য হতো। গোপনে শুকাতে দিত সেসব কাপড়। এতে বেড়ে যেত স্বাস্থ্য ঝুঁকি। আমরা দেখেছি অনেক মেয়ে নোংরা কাপড় ব্যবহার করে, এতে ইনফেকশন দেখা দেয়। যা সে নিজেও বুঝতে পারে না। আবার কারো সঙ্গে আলোচনা করারও সুযোগ নেই।
 
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্ধেক শতাংশ নারী। এদের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে আমাদের পথচলায় হোঁচট খেতে হবে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ২৫ শতাংশ মেয়ে মাসিকের সময় স্কুল কামাই করে।
 
২০১৪ সালের জাতীয় স্বাস্থ্যবিধির ভিত্তি জরিপে দেখা গেছে, স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের এক-চতুর্থাংশ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। আর অনুপস্থিত থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে বেশিরভাগ স্কুলে নেই পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা। যে কারণে মেয়েরা স্কুলে আসতে অনাগ্রহ দেখায়।
 
সরকার ২০১১ সালে সেক্টর উন্নয়ন-২০১৫ পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এতে ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি টয়লেট থাকা মানদণ্ড নির্ধারণ করে। কিন্তু এক জরিপে দেখা গেছে, গড়ে ১৮৭ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি টয়লেট রয়েছে। তারও ৪৫ শতাংশ থাকে তালাবদ্ধ। আবার টয়লেট রয়েছে কিন্তু পানি নেই এমন ঘটনাও বিরল নয়।
 
২০১৫ সালের পরিপত্রে স্কুলের বাথরুম পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ম্যানেজিং কমিটিকে। কিন্তু অনেক টয়লেটে দেখা গেছে, আলোর ব্যবস্থা নেই, মেয়েদের জন্য আলাদা বাথরুম নেই। অর্থাৎ কাজীর গরুর মতো, কেতাবে আছে কিন্তু গোয়ালে নেই।
 
বাংলাদেশ সময়: ১২০৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৮
এসআই/আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।