ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

‘কর্তৃপক্ষের নির্দয়-নির্মম আচরণেই অরিত্রীর আত্মহত্যা’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০১৮
‘কর্তৃপক্ষের নির্দয়-নির্মম আচরণেই অরিত্রীর আত্মহত্যা’ সাংবাদিকদের তদন্ত প্রতিবেদন জানাচ্ছেন শিক্ষামন্ত্রী

ঢাকা: অরিত্রী ও তার বাবা-মায়ের সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্মম, নির্দয় আচরণ অরিত্রীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

রাজধানীর নামি প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ছাত্রী অরিত্রীর আত্মহননেরর পর গঠিত কমিটি স্কুলটির নানা অনিয়মের সত্যতাও পেয়েছে। স্কুলটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অধিকতর তদন্তেও যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

 
 
নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রীকে পরীক্ষার হলে মোবাইলে নকল করার অভিযোগ পেয়ে তার অভিভাবককে ডেকে অপমান ও হেয় করা হয়। মেয়ের সামনে বাবা-মাকে অপমান করার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয় এই স্কুলছাত্রী। সহপাঠীর অকাল মৃত্যুতে ফুঁসে উঠেছে বেইলী রোডের এই প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রীরা।
 
তিন দিন আগে অরিত্রীর আত্মহননের পরপরই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি রাতদিন কাজ করে প্রতিবেদন দেয় বুধবার (৫ ডিসেম্বর)।
 
এরপর দুপুর সাড়ে ১২টায় সচিবালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের চুম্বুক অংশগুলো তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
 
অরিত্রীর অকাল মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে নাহিদ বলেন, আমরা মর্মাহত, ব্যথিত। খুবই অমানবিক…। ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন ছাত্রী পরীক্ষা দিচ্ছিল, সেখান থেকে সূচনা। তারপরে পরবর্তীতে যে ঘটনা ঘটেছে এর ফলে সে আত্মহত্যা করে।  

বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুত দেওয়া হয়েছে বলে জানান নাহিদ।
 
‘নরমালি ডিলে হয়, কিন্তু এটা এমন একটা বিষয় যা দেরি করবার মতো নয়। যার ফলে সদস্য-কর্মকর্তারা সবাই মিলে সহযোগিতা করে চেষ্টা করেছি যাতে দ্রুতই করতে পারি। ওই রাত তারা সম্পূর্ণ খেটেছেন, পুরো দিন কাজ করেছেন এবং গত রাত আড়াইটায় এসে পৌঁছেছেন। ’
 
নাহিদ বলেন, প্রতিবেদন আমরা পেয়েছি, প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছি। প্রতিবেদনে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হয়েছে।

 
কী উঠে এসেছে তদন্তে?
তদন্ত প্রতিবেদন থেকে কিছু অংশ পাঠ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এখানে বলা হয়েছে, এই তিনজন, অরিত্রীর বাবা-মা যখন আবেদন নিয়ে আসলেন, তারা খুবই অসুস্থ, তাদের ভয়-ভীতি দেখান, অরিত্রীর বাবা-মায়ের সঙ্গে অধ্যক্ষ, শিফট ইনচার্জ নির্মম, নির্দয় আচরণ অরিত্রীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।
 
‘অরিত্রীর বাবা-মায়ের প্রতি অপমান ও অসম্মানের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি বলেই তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়। যার দায় কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান, সিফট ইনচার্জ এবং শ্রেণি শিক্ষিকা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। ’
 
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে অরিত্রীর আত্মহত্যায় প্ররোচণাকারী হিসেবে অভিযোগে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া পারে।
 
তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৗস, প্রভাতী শাখার প্রধান জিন্নাত আরা এবং শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে বরখাস্ত করার জন্য গর্ভনিং বডিকে নির্দেশ দিচ্ছি। একই সঙ্গে এই তিনজন শিক্ষকের এমপিও বাতিল করার জন্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেওয়া করেছে।
 
‘পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, পুলিশও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারবে না। থানাও যোগাযোগ করেছে আমাদের সঙ্গে। আমি আশা করছি তারাও ব্যবস্থা নেবেন। থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। ’
 
হুঁশিয়ারি বার্তা সবার জন্য
অরিত্রীর ঘটনা কেন্দ্র করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এ ধরনের ঘটনা যদি নাও হয়ে থাকে তাহলেও নানা কারণে নানাভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
 
‘আমরা সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ম্যানেজিং কমিটি কিংবা সরকারি হলে তার পরিচালক, মাধ্যমিক, প্রাইমারি স্কুল, ইউনিভার্সিটি, মাদরাসা, টেকিনিক্যাল প্রতিষ্ঠান আছে; সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, আমাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতন করা যাবে না। এটা অপরাধ। এই হিসেবে যারা শাস্তি পেয়েছেন তারা তো পেয়েছেন, আর যারা করবেন তারা আরো বেশি করে শাস্তি পাবেন।
 
পাশাপাশি তিনি বলেন, সব শিক্ষক এরকম নয়। ভালো শিক্ষক রয়েছেন। দরদি শিক্ষক রয়েছেন, শিক্ষার্থীকে ভালোবাসেন- এমন শিক্ষক আরো বেশি এগিয়ে আসবেন, অন্য শিক্ষককে প্রভাবিত করবেন।
 
‘ম্যানেজিং কমিটিতে যারা আছেন, তারা শুধুখবরদারি করার জন্য নয়, সার্বিকভাবে শিক্ষার উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের-শিক্ষকের গুণগতমান উন্নয়ন, মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়নে আরো বেশি করে নজর দেবেন। আমরা আরো বেশি নজরদারি করবো। ’
 
অন্তহীন অভিযোগ ভিকারুননিসায়!
এই নামি প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য অভিভাবকেরা গলদঘর্ম হয়ে পড়েন। কিন্তু তার আড়ালে রয়েছে অন্ধকার সব কর্মকাণ্ড!
 
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে যে সব অনিয়ম ও অসঙ্গতি রয়েছে সেগুলো উঠে এসেছে। অভিভাবকেরা নানা ধরনের অভিযোগ করেছেন। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পরে আমি অসংখ্য টেলিফোন পাচ্ছি। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে এসে তাদের ক্ষোভের কথা জানাচ্ছেন।
 
‘অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তি বলেননি। বলে যে আমরা সাহস পাইনি, বললে তারা আমার মেয়েকে নানা রকমের সমস্যায় ফেলতে পারে সেই কারণে…। একজন অতি ক্ষমতাবান ব্যক্তি আমাকে বলেছেন যে আমি অপদস্থ হয়েছিলাম। বলে যে, সাহস করিনি, আমার নাতনির জীবন শেষ হয়ে যায় এ কারণে। ’
 
তিনি বলেন, আমরা আরো অনেকগুলো অনিয়ম, অসঙ্গতির বিষয় গার্ডিয়ান, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পেয়েছি। ওখানে বহুদিন ধরে অধ্যক্ষ নেই, একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তারা নিয়ম অনুসরণ করে অধ্যক্ষ নিয়োগ করেনি। এটাও বড় ধরনের অনিয়ম। এর বাইরে তারা নিয়মের বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি করায়।
 
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে নাহিদ বলেন, আমরা প্রথম যখন দায়িত্ব নেই, ১০ লাখ টাকা লাগে একজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করতে! সেটা বন্ধ করবার জন্য আমরা প্রভাতী সিস্টেম চালু করি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে অনুমতি পায় তার চেয়ে বেশি ভর্তি করে ফেলে। তার মানে অন্য কোনো পথে করে। আমরা শাখা অনুমোদন দেই না, দেখা যাচ্ছে তারা শাখা খুলে বসে আছে। এই তথ্যগুলো কেউ বলে না। এতো ঘটনা শোনা যায় বাহ্যিকভাবে, মিডিয়ার মাধ্যমে, পত্রিকায়-টেলিভিশনে আমরা পাই, কিন্তু কোনো গার্ডিয়ান বলতে চান না।
 
‘ওই প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর জন্য অভিভাবকরা আগ্রহী। সুনাম হয়ে গেছে, সামাজিক একটা স্ট্যাটাস হয়ে গেছে। এর আসল চেহরাটা উন্মুক্ত হয়েছে। আমরা এই চেহারাটা খুলে দেবো। আজ যে চেহারা প্রকাশিত হয়েছে মানুষের দৃষ্টি খুলে দেবে। ’
 
নাহিদ বলেন, অভিযোগ ছাড়া কোনো অ্যাকশন নিতে পারি না। কেউ অভিযোগ করে না।
 
হাইকোর্টের সুয়োমুটো নিয়ে এগোচ্ছে মন্ত্রণালয়
হাইকোর্ট এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনিয়মকে আমলে নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অধিকতর তদন্তের নির্দেশনা দিয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, মহামান্য হাইকোর্ট সুয়োমোটো এনেছেন, তারা নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা এই নির্দেশ পালন করবো, মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে পাঁচজনের কমিটি আজকেই করে দেবো।
 
‘এটা আমাদের জন্য যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে, কারণ হাইকোর্ট এটা নির্দেশ দিলে আমরা করার জন্য সাহস পাই, যেটা করা উচিত সেটা করতে সক্ষম হবো। হাইকোর্ট আমাদের গার্ডিয়ান হিসেবে কাজ করবে। ’
 
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমাদের ক্ষমতা আছে আমরা পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে পারি। কাজটা ওদের করতে হবে, না করলে আমরা বাধ্য হবো। রিপোর্ট তৈরি করে হাইকোর্টের সমর্থন নিয়ে কাজটা আমরা করতে পারবো, আইনত কোনো বাধা নেই।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৮
এমআইএইচ/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।