প্রাথমিক শিক্ষায় বৈষম্য দৃশ্যমান। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে রয়েছে কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষার পেছনেই দেদারছে টাকা ঢালতে হচ্ছে অভিভাবকদের। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ধনী, মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভিভাবকরাও প্রাথমিক শিক্ষায় বড় অংকের টাকা ব্যয় করছেন। সেক্ষেত্রে ধনী অভিভাবকদের জন্যও বিষয়টি কষ্টকর না হলেও মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠছে। আর নিম্ন মধ্যবিত্তদের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা এখন কঠিন এক বাস্তবতা। বাধ্য হয়ে তাদের সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন।
টানা ক’দিন প্রাথমিক শিক্ষার হালচাল সম্পর্কে সরেজমিনে তথ্যানুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন শুধুই গরিবের স্কুলে পরিণত হয়েছে। দেখা গেছে, বিত্তবান বা স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরা সাধারণত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে না।
আবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ওপর কেস স্টাডি করে দেখা গেছে, শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীর অভিভাবকই নিম্নবিত্ত বা হতদরিদ্র শ্রেণির। অবস্থাসম্পন্ন পরিবার তাদের সন্তানকে সরকারি স্কুলে না দিয়ে কিন্ডারগার্টেন বা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করায়।
বিত্তবান অভিভাবকদের অনেকেই শিক্ষার পরিবেশের কথা চিন্তা করে তাদের ছেলেমেয়েকে অভিজাত স্কুলে ভর্তি করে থাকেন। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে পড়াশোনা করা মানেই মোটা অংকের টাকা খরচ। যা সাধারণ পরিবারগুলোর পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। তারপরও ভালো লেখাপড়ার আশায় শহরে নামিদামি স্কুলগুলোতে সন্তানদের ভর্তি করিয়ে শিক্ষার ব্যয়ভার চালাতে গিয়ে মধ্যবিত্তরা হিমশিম খাচ্ছেন।
অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার পাশে বেসরকারি স্কুলের প্রচুর শিক্ষাব্যয় নিয়ে চলছে এখানকার শিক্ষাঙ্গন। মানসম্মত শিক্ষার সংকট নিয়ে কথা চলছেই।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার নিচকল্পা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যালয়টির ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীর অভিভাবক শ্রমিক, রাজমিস্ত্রী বা অটোরিকশা চালক। মাত্র ৫ ভাগ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত পরিবারের। যারা বিদ্যালয়টিতে প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্তই পড়ালেখা করে। তারপর চলে যায় অন্য কোথাও।
শহরের ১২২ নং শাঁখারিপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী শ্যামা রাণীর বাবা পুড়িসিঙ্গারার দোকানদার। সামান্য আয়েই চলে তাদের সংসার। এই বিদ্যালয়েরই চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী পুষ্পিতা মিত্রের বাবা মুদি দোকান চালান।
শহরের ১১৫ গোলকীবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী দুই যমজ ভাই রফিকুল ইসলাম রাজা ও শফিকুল ইসলাম বাদশা। তাদের বাবা রিকশাচালক। একই শ্রেণির আরেক ছাত্র তানভীর হাসানের বাবা সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক।
একই অবস্থা ময়মনসিংহের বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়েরই। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা জানান, বিত্তবান বা স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরা সাধারণত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে না। তারা কিন্ডারগার্টেনে পড়ে। ফলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে যাচ্ছে গরিরের বিদ্যাপীঠ।
৫২ নং সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যায়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন বাংলানিউজকে বলেন, আজকাল অভিভাবকরা মনে করেন টাকা দিয়ে পড়ালে সন্তানদের লেখাপড়া ভালো হয়। অনেকেই চায় সতীর্থদের পারিবারিক পরিবেশও যেন ভালো হয়।
স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান এই বিদ্যালয়ে পড়ে মাত্র ৫ শতাংশ। অস্বচ্ছল পরিবারের মা সকালে বাসা-বাড়িতে কাজে যাওয়ার সময় বলে যায় তোমরা স্কুলে যেও। কিন্তু মা-বাবার কোনো কেয়ার না থাকায় কেউ স্কুলে যায়, কেউ যায় না।
শহরের শাঁখারিপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এক ছাত্রীর বাবা কমল মিত্র বাংলানিউজকে জানান, অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াশোনা করানোর মতো সামর্থ্য নেই তাদের। নিজের মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলতে এছাড়া আর কোনো বিকল্পও নেই।
অবশ্য এখানকার শহর বা গ্রাম প্রায় সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই নিয়মিত পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি চারু-কারু ও শারীরিক শিক্ষার ক্লাস নেওয়া হয়। শিক্ষকরা প্রতিটি ক্লাসেই প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করেন। তবে বেশিরভাগ বিদ্যালয়েই নিয়মিত সমাবেশ হয় না। বার্ষিক ক্রীড়াসহ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস পালিত হয় সবখানেই।
ময়মনসিংহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, গ্রামাঞ্চলের কৃষক ও স্বচ্ছলরা প্রাইমারিতে পড়ে। তবে শহরে স্বচ্ছল পরিবারের সংখ্যাটা কম। তারাও কিন্ডারগার্টেন স্কুলে যায় এটা সত্য।
তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষকরা যাতে সঠিকভাবে পাঠদান করে বিদ্যালয়ের ফলাফল ভালো করতে পারেন। এটা করলেই কিন্ডারগার্টেন স্কুল বিমুখ হবে শিক্ষার্থীরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৮
এমএএএম/এমজেএফ