সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শুধু ক্লাস নেওয়া, শিক্ষার্থীদের পড়ানোই কাজ নয়।
ময়মনসিংহের বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, বাড়তি কাজের চাপে শিক্ষকদের পাঠদানে বিঘ্ন ঘটে। শিক্ষকরাও জানান, শিক্ষার্থীদের পাঠদান ছাড়াও তাদের অনেক বিষয় নিয়েই কাজ করতে হয়। অনেক সময় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিভিন্ন কাগজপত্র প্রস্তুত করা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপবৃত্তির কাগজপত্র প্রস্তুত করা, শিক্ষার্থীর মায়ের ছবি, আইডি নম্বর, মোবাইল নম্বর সংগ্রহ, এলাকার ৪ বছর থেকে ১৫ বছরের শিশুদের ওপর জরিপ চালানো, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ, খোঁজ খবর নেওয়া, বই বিতরণ, পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, পরীক্ষা নেওয়া ও ফল প্রকাশসহ নানাবিধ কাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেরাই করে থাকনে।
এছাড়াও রয়েছে অভিভাবকদের সাক্ষাৎকার, মতবিনিময় ও শিক্ষার্থীদের ‘হোম ভিজিট’। বিশেষ করে প্রধান শিক্ষকের ওপর থাকে ব্যাপক চাপ। এসব কাজ সম্পাদনের জন্য কোনো অফিস সহকারী নেই।
সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পাদনের ক্ষেত্রে একজন অফিস সহকারী থাকা সময়ের প্রয়োজন।
প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ানো, অতি দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা এবং ঝরেপড়া রোধ করতে শিক্ষার্থীদের মাসিক ১০০ টাকা করে উপবৃত্তি দেওয়া হয়।
তবে শিক্ষার্থীদের এই উপবৃত্তির আওতায় আনতে শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে ছুটতে হয়। দিনের পর দিন সময় ব্যয় করতে হয় এ কাজে।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার নিজকল্পা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নাসরিন সুলতানা বাংলানিউজকে জানান, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে পরিচ্ছন্নতার কাজও করতে হয়। উপবৃত্তির কাজের জন্য শিক্ষকদের ক্লাসে ব্যাঘাত ঘটে।
কোনো অফিস সহকারী না থাকায় উপবৃত্তি তৈরি করতেই একজন শিক্ষকের ১৫ থেকে ২০ দিন সময় দিতে হয়। শিক্ষকরা ক্লাস ফেলে উপবৃত্তির কাজে সময় দেন।
একই রকম তথ্য জানিয়ে ফুলবাড়িয়া উপজেলার ৪০ নং জোরবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, ভোটার তালিকার কাজ, শিশু জরিপসহ অনেক কাজই শিক্ষকদের নিজের হাতে সামলাতে হয়।
শহরের গোলকিবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, পরিচ্ছন্নতার কাজের জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজস্ব টাকায় বেতনে একজন আয়া রেখেছেন। সপ্তাহে দুই দিন তিনি বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজ কর্ম করেন।
জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার কুমারগাতা ইউনিয়নের সবু সরকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, ১২ মাসই বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় শিক্ষকদের। এই সময় ক্লাস চালিয়ে যাওয়াই চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ে।
অভিভাবকরা অনেক সময় অভিযোগ করেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস হয় না। কিন্তু শিক্ষকরা যখন কাগজপত্র তৈরিতে সময় দেন তখন রুটিনওয়ার্ক ব্যাহত হয়, দাবি শিক্ষকদের।
স্থানীয় ঘোষবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাসুমুল আলম জানান, কোন বিদ্যালয়ের জমির দলিল ঠিক আছে কি না বা পরিমাপ কত এসব বিষয়ও শিক্ষকদেরই করতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন রেজিস্ট্রারও মেইনটেইন করতে হয়।
এসব শিক্ষকরা জানান, এক সময় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরিও ছিলো না। ২০১৪ সালের মে মাসের দিকে প্রথমবারের মতো সরকার বিভিন্ন স্কুলে দপ্তরি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে অনেক বিদ্যালয় এখনো দপ্তর নিয়োগের আওতায় আসেনি। কোথাও দপ্তরি নিয়োগে আবার সীমাহীন বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে।
ময়মনসিংহ শহর এবং গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষকই মনে করেন, সরকারি এসব বিদ্যালয়ের সার্বিক ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষতার স্বার্থে প্রধান শিক্ষকের দাপ্তরিক কার্যক্রমে সহায়তার জন্য একজন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া দরকার। তাদের কাজই হবে প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র তৈরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজ বাস্তবায়ন করা।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এসব সমস্যার বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা ময়মনসিংহ বিভাগের বিভাগীয় উপ-পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষকদের এসব করতেই হবে। আমাদের নিজেরও কোনো অফিস সহকারী নেই। হয়তো একসময় পর্যায়ক্রমে সবখানেই অফিস সহকারী নিয়োগ দেওয়া হবে। এক সময় দপ্তরিও ছিলো না, এখন হয়েছে। আর পরিচ্ছন্নতার কাজটি রুটিনের অংশ।
তবে অফিস সহকারী নিয়োগ দেওয়াটা জরুরি বলে মনে করেন এই বিভাগীয় উপ-পরিচালক।
পড়ুন অন্যান্য কিস্তি
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শুধুই গরিবের স্কুল!
কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কাছে মার খাচ্ছে সরকারি প্রাথমিক
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৯
এমএএএম/এমজেএফ