ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি কায়ছার আহম্মেদ জয়, সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর মিয়াসহ পাঁচ শিক্ষক ও অন্তত ১৫ শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ আট শিক্ষার্থী ও একজন শিক্ষক বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘদিনের এ অহিংস আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখনও নেয়নি কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা না করে আন্দোলন শুরু হতেই ঢাকায় চলে যান উপাচার্য। যদিও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) মেয়রের হস্তক্ষেপে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একবার বৈঠক হয়, তবে তাতেও আন্দোলন থেকে পিছু হটেননি শিক্ষার্থীরা। তারা উপচার্যের পদত্যাগ, নয়তো মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছুটির দাবি জানান।
এরপর থেকেই নিয়মিত মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি, মহাসড়ক অবরোধ, প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রিকেট টুর্নামেন্টের মতো কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষার্থীরা। তাদের নিবৃত্ত করতে উপাচার্য, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রারসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কাউকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়নি। বরং তাদের দাবি, শিক্ষার্থীরা একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনের গেট আটকে দেওয়ায় তারা ভেতরে যেতে পারেন না।
আন্দোলনের টানা ২৯ দিন পার হওয়ার পর কোনো ফলাফল না পেয়ে ৩০তম দিন থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচির পথ বেছে নেন শিক্ষার্থীরা। এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে যোগ দেন শিক্ষকরাও।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, আন্দোলন শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের না রাখা নিয়ে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে বরং শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দেন উপাচার্য। এ নিয়ে তার পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভের ঝড় ওঠে গত ২৬ মার্চ বিকেল থেকেই। এরপর শরীরের রক্ত দিয়ে দেয়াল লিখন, কুশপুতুল দাহ, মশাল মিছিল, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, সড়ক অবরোধ, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীসহ প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়াসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়।
আন্দোলনকারীরা বলেন, এসব কর্মসূচিতে যেন কারো কিছু আসে যায় না। উপাচার্য শিক্ষার্থীদের রাজাকারের বাচ্চা বলেননি দাবি করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু যখনই তার বক্তব্যের অডিও প্রকাশ পেয়েছে, তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকলে রেজিস্ট্রার আবার বিশ্ববিদ্যালয় চালুর ঘোষণা দেন। এরপর উপাচার্য বন্ধ করে দেন ব্যাংকের হিসাব। এতে বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এর কয়েকদিন পরে আবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। উপাচার্য তার কাজ করেই চলেছেন, তাহলে আমরা (শিক্ষার্থীরা) আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াবো কি কারণে? আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নেতা লোকমান হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা শুরুতে স্বৈরাচার উপচার্যের পদত্যাগ কিংবা পূর্ণমেয়াদে ছুটিতে যাওয়ার আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু উপচার্য নানাভাবে শিক্ষার্থীদের অপবাদ দিচ্ছেন এবং মিথ্যাচার করছেন। আমরা এসবের তীব্র নিন্দা জানিয়েছি। পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলে গত বুধবার (২৪ এপ্রিল) থেকে আমরণ অনশনে বসেছি। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের একটাই দাবি, যেন উপচার্যকে অপসারণ করা হয়, নয়তো পূর্ণমেয়াদে ছুটিতে পাঠানো হয়।
তিনি বলেন, আমরা ক্লাসে ফিরতে ও পরীক্ষা দিতে চাই, যেন সেশনজটে না পড়ি। তবে দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। বরিশালবাসী শুরু থেকেই আমাদের এ অহিংস আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে আসছেন। আশা করি, যার যার অবস্থান থেকে যা করণীয় তারা তা করবেন।
এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষক সমিতির আট দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন অনেক আগে থেকেই করার কথা ছিলো। আমরা আমাদের দাবি-দাওয়া উপাচার্যকে জানালে তিনি সেসব পূরণের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সিন্ডিকেট মিটিংয়ে তা করেননি।
তিনি বলেন, মহান স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা না থাকা এবং একইদিন উপাচার্যের বক্তব্যকে ঘিরে গত ২৬ মার্চ শিক্ষার্থীরাই আন্দোলনে নেমে যায়। তাদের আন্দোলনে উঠে আসা দাবিগুলোতে শিক্ষকরা সহমত ছিলেন আগে থেকেই। পরে শিক্ষক-কর্মচারী ও কয়েকজন কর্মকর্তাও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন। এসবের ধারাবাহিকতায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপচার্যের অপসারণ দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালনের পথ বেছে নেন।
শিক্ষক সমিতির নেতা বলেন, হতাশার বিষয় হচ্ছে, মাত্র একজনের জন্য এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন চলছে। অথচ তাতে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সাড়ে সাত হাজার সদস্যের কথা কেউ ভাবছে না। এ অচলাবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি আমাদের সন্তান অর্থাৎ শিক্ষার্থীদেরই হচ্ছে।
তিনি বলেন, এতোদিন আন্দোলন করেও শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি আদায়ের বিষয়ে আস্থা রাখার মতো কারো আশ্বাস পাচ্ছে না। আবার বিগত দিনে কর্তৃপক্ষের কর্মকাণ্ডের কারণেও মুখের কথা বিশ্বাস করছে না তারা।
আবু জাফর মিয়া বলেন, অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সিন্ডিকেটের সদস্য আছেন, যারা উদ্যোগী হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অচল অবস্থা নিরসন সম্ভব। অথচ টানা এ আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের খোঁজ নিতে তেমন কেউ আসেননি। আমরণ অনশনেও বোর্ড চেয়ারম্যান ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা ছাড়া আর কেউই আসেননি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৯
এমএস/একে/আরবি/