রোববার (১৩ অক্টোবর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত এলজিআরডি ভবনে অনুষ্ঠিত এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্ট ২০১৮-১৯ গবেষণা ফলাফলের প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল।
গণসাক্ষরতা অভিযানের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীর সঞ্চালনায় এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের ভাইস চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদের সভাপতিত্বে অতিথি হিসেবে উপস্থতি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বাস্তবায়ন বিষয়ক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ।
অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফর উপস্থাপন করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান গবেষক সমীর রঞ্জন নাথ। এ গবেষণায় দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজ, দাখিল মাদ্রাসা এবং উচ্চতর মাদ্রাসার শিক্ষকদের উন্নয়নে গৃহীত নীতিমালা, শিক্ষকদের সামাজিক, শিক্ষাগত, পেশাগত ও অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষাক্রম ও শিখন পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। একসঙ্গে শিক্ষক সমিতির ভূমিকা ও কার্যাবলী, চতুর্থ টেকসই উন্নয়ন (এসডিজি-৪) অভিষ্টের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থা এবং শিক্ষকদের জীবন দক্ষতা ও বোধগম্যতা, সংশ্লিষ্ট বিভাগের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আর এ গবেষণায় ৩ হাজার জন শিক্ষক অংশ গ্রহণ করেন দৈব চয়নের মাধ্যমে।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক দিয়ে প্রায় ৫৮ শতাংশ শিক্ষক জীবনের প্রথম তিনটি সার্বজনীন পরীক্ষায় (মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক) প্রত্যেকটিতে কমপক্ষে দ্বিতীয় বিভাগ অর্জন করেছিলেন। স্নাতকোত্তর পরীক্ষা বিবেচনায় নিলে ৩৩ দশমিক ২ শতাংশে নেমে যায় এই ফল। একই সঙ্গে দুই তৃতীয়াংশ শিক্ষকের পেশাগত প্রশিক্ষণ রয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের তুলনায় এগিয়ে আছেন।
শিক্ষকদের জীবনের লক্ষ্যের কথা জিজ্ঞেস করায় নমুনা প্রশিক্ষকরা বিভিন্ন ধরনের উত্তর করেছেন। তবে বেশিরভাগ (৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ) উত্তরদাতা শিক্ষকতার কথা বললেও অন্যরা ডাক্তার, প্রকৌশলী, সরকারি চাকরি, পুলিশ বা প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা, ব্যাংকার অথবা ব্যবসায়ী হতে চেয়েছিলেন। এছাড়া নমুনাভুক্ত শিক্ষকরা তাদের প্রধান পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে উল্লেখ করলেও দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষক জানিয়েছেন যে তাদের দ্বিতীয় একটি পেশাও রয়েছে। যা কৃষি কাজ বা ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
তবে সবথেকে বড় বিষয় হয়ে উঠে এসেছে যে, শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক আয় বৈষম্য রয়েছে। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আয় সব থেকে বেশি। তাদের আয়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ১ দশমিক ৯ গুণ; আর এমপিওভুক্ত নন, এমন শিক্ষকদের তুলনায় ৩ দশমিক ৮ গুণ। এছাড়া এক বছরের আয় ও ব্যয় বিশ্লেষণ করে ৫ শতাংশ শিক্ষক জানিয়েছেন তারা সবসময়ই অভাবে ছিলেন। ২০ দশমিক ২ শতাংশ জানিয়েছেন তারা মাঝেমধ্যে অভাবে ছিলেন। ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ জানিয়েছেন তারা খেয়ে পড়ে সমান ছিলেন। আর ৪০ শতাংশ শিক্ষক জানিয়েছেন বছরের সব খরচ মিটিয়ে তাদের কিছু টাকা উদ্ধৃত ছিল।
এই গবেষণায় শিক্ষকরা পেশা এবং প্রতিষ্ঠান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও সম্মানি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তারা তা করেননি। পেশা, প্রতিষ্ঠান ও প্রাপ্ত সম্মানি তিনটি ক্ষেত্রে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মাত্র ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষক। আর এদের অধিকাংশই সরকারি বিদ্যালয়ের। এছাড়া দীর্ঘদিন কাজ করে গেলেও গ্রেড বা পদবীর কোন পরিবর্তন হয় না বলেও ফলাফল উঠে এসেছে এই গবেষণায়।
গবেষণাভুক্ত ৩১ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ পাওয়া গেছে কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির ল্যাব পাওয়া যায়নি। ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তির ল্যাব আছে কিন্তু মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ নেই। ২২ দশমিক ৫ শতাংশে উভয়ই আছে এবং ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে এর কোনোটিই নেই। তবে শিক্ষকরা তথ্যপ্রযুক্তির সামগ্রী ব্যবহার করেছেন ইন্টার্নেট ব্রাউজিং, ফটোগ্রাফি, গান শোনা, নাটক দেখা, ধর্মীয় প্রচারণা শোনা, মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠদান, অর্থ স্থানান্তর, শিক্ষাবস্তু তৈরি, অধ্যায়ন, লেখালেখি এবং বেতারের অনুষ্ঠান শোনাকে কেন্দ্র করে।
আর মোট গবেষণার দুই পঞ্চমাংশ শিক্ষক দাবি করেছেন যে তারা টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট সমূহ সম্পর্কে শুনেছেন। তবে কার নেতৃত্বে এটি প্রণীত হয়েছে তা কেবল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষক জানতেন। খুব কম সংখ্যক শিক্ষকই টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট সমূহের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সচেতন বলে প্রতীয়মান হয়েছে এ গবেষণায়।
গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ ও টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট সমূহের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য পর্যালোচনা করে কিছু সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হয় শিক্ষকদের জন্য। এগুলোর মধ্যে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাতের একটি উপযোগী মাত্রা নিশ্চিত করা; প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষক দ্বারা শ্রেণির কার্যক্রম পরিচালনা করার লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণের সক্ষমতা বাড়ানো; এবং শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির প্রতি অধিকতর গুরুত্বারোপ উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া শিক্ষকদের সন্তুষ্টি এবং কাজে উৎসাহ উদ্দীপনায় বৃদ্ধির প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রেডের পরিবর্তনের সঙ্গে পদবির পরিবর্তন; দক্ষতার উপর ভিত্তি করে বাৎসরিক শিক্ষক মূল্যায়ন; এবং একুশ শতকের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক সমিতির ভূমিকা পর্যালোচনা করার বিষয়টি অন্যতম।
আরো পড়ুন: পাঠ্যবই সমস্যার সমাধান শিক্ষার্থী একা করতে পারবে না
বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৯
এইচএমএস/এসএইচ